অজ্ঞাত রোগ শনাক্তে সারা বছর তৎপর যারা

অজ্ঞাত রোগের কথা শুনলেই মানুষের মনে একধরনের শঙ্কা কাজ করে। শঙ্কা দূর করতে এই ধরনের রোগ শনাক্ত করার কাজ করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষায়িত একটি দল। নাম ‘র‌্যাপিড রেসপন্স টিম’। দেশের কোথাও অজ্ঞাত রোগে মানুষ বা পশুপাখি আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনলেই চার ঘণ্টার প্রস্তুতিতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারে দলটি।

স্বাধীনতার পর থেকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে উন্নতির লক্ষ্যে সরকার যে কটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম আইইডিসিআর। এর প্রধান কাজ: রোগের ওপর নজরদারি এবং নতুন রোগ শনাক্ত বা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধান করা। শেষের কাজ দুটি বছরব্যাপী করে র‌্যাপিড রেসপন্স টিম।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজটি করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। আমরা ঘটনা জানি বা শুনি, ঘটনা যাচাই করি, ঘটনাস্থলে র‌্যাপিড রেসপন্স টিম পাঠাই। এই কাজটি সারা বছর ধরে চলে। এই মহামারির সময়েও অন্য রোগের অনুসন্ধান বন্ধ থাকেনি।’

এ বছরের শুরুতে ঝিনাইদহ থেকে খবর এসেছিল, অজ্ঞাত কারণে গরু মারা যাচ্ছে। ছুটে গিয়েছিল র‌্যাপিড রেসপন্স টিম। জানা যায়, একটি বেসরকারি ব্যাটারি কারখানা থেকে সিসা ছড়িয়ে পড়ছে। গরু মৃত্যুর কারণ সিসা। আইইডিসিআর আরও জানতে পারে, সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত এলাকার শিশুরাও। দেড় মাস আগে বরিশাল বিভাগের কয়েকটি স্থানে হঠাৎ ডায়রিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। কারণ অনুসন্ধানে গিয়েছিল দলটি।

আইইডিসিআরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, বছরে গড়ে ২২টি ঘটনা তারা অনুসন্ধান করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন বা অজ্ঞাত রোগের তথ্য আমরা পাই গণমাধ্যম থেকে। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা জেলা সিভিল সার্জনদের কাছ থেকেও আমরা নতুন ঘটনা সম্পর্কে আনতে পারি। সূত্র যা-ই হোক, ছুটে যাই দ্রুত।’

তিন স্তরের নেটওয়ার্ক

আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে র‌্যাপিড রেসপন্স টিমের তিন স্তরের একটি নেটওয়ার্ক আছে। সবচেয়ে নিচের স্তরে আছে উপজেলা র‌্যাপিড রেসপন্স টিম। ৯ সদস্যের এই দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

এর ওপরে আছে জেলা র‌্যাপিড রেসপন্স টিম। ১৩ সদস্যের এই দলের প্রধান জেলা সিভিল সার্জন। ঢাকায় আইইডিসিআর কার্যালয়ে আছে ন্যাশনাল র‌্যাপিড রেসপন্স টিম। কেন্দ্রীয় দলটিতে কমপক্ষে সাতজন সদস্য থাকে। এর নেতৃত্বে থাকেন প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

বিশেষায়িত অনুসন্ধান

কেন্দ্রীয় এই দলটি প্রয়োজনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদেরও সঙ্গে নেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ও গবেষক নিয়মিতভাবে আইইডিসিআরের দলে যুক্ত হয়ে সারা দেশে কাজ করেন। আইসিডিডিআরবির সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের সহকারী বিজ্ঞানী ও প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধান দলের প্রধান ডা. সৈয়দ মইনুদ্দিন সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজটির সবটাই কারিগরি বিষয়। দল গঠন, প্রস্তুতি, যাত্রা শুরু, মাঠের কাজ—সবকিছু হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে। এই কাজে যুক্ত প্রত্যেকেরই প্রশিক্ষণ থাকতে হয়।’

এ এস এম আলমগীর ও সৈয়দ মইনুদ্দিন সাত্তার অনেক অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, একটি অজানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রয়োজন পড়ে। দলের সদস্যদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া যে স্থানে বা জনগোষ্ঠীতে অনুসন্ধান চালাতে হয়, সেখানকার সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ব্যবস্থার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়।

আইইডিসিআরের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩১০টি ঘটনার অনুসন্ধান করেছে তারা। চলতি বছরে করেছে ৯টি অনুসন্ধান।

এসব অনুসন্ধান থেকে দেশের মানুষ নিপাহ, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুর মতো রোগ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ডিফথেরিয়ার প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করেছিল আইইডিসিআরের র‌্যাপিড রেসপন্স টিম।

নতুন রোগ শনাক্ত করে বা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ নির্ণয় করে দায়িত্ব শেষ করে না আইইডিসিআর। এরপর তারা মানুষের জন্য স্বাস্থ্য বার্তা তৈরি করে, মানুষকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত বুলেটিন প্রচার করে, সংবাদ ব্রিফিং করে, বিভিন্ন রোগনিয়ন্ত্রণ কিটের যথার্থতা যাচাই করে, রোগটির ঝুঁকির বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং সরকারকে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেয়।

রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান দীর্ঘদিন এই অনুসন্ধান কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন স্বাধীন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘৫০ বছর আগে রোগের বিষয়ে অনুসন্ধান আজকের পদ্ধতিতে হতো না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় কাজগুলো হতো। এখন নতুন রোগ শনাক্ত করা বা প্রাদুর্ভাবের কারণ জানার পাশাপাশি অনুসন্ধানের একটি উদ্দেশ্য থাকে রোগটি যেন দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। র‌্যাপিড রেসপন্স টিম যত দ্রুত কাজ করে, রোগনিয়ন্ত্রণ তত সহজ হয়।’