‘আমরারে কেউ আইয়া দেখছে না’

ফাইল ছবি

দুই দিন বৃষ্টি কম হওয়ায় সুনামগঞ্জ শহর থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে পানি নামছে খুব ধীরে। এখনো শহরের ৯০ ভাগ বাড়িঘরে বন্যার পানি রয়ে গেছে। তাই মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও খাদ্যসংকট রয়েছে।

কিছু দোকানপাট খুলেছে। মানুষজন বাজারসদাই ও ওষুধপত্র কিনতে বেরিয়েছেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেল।

সকালে শহরের ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে অন্তত ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পায়নি। ভবনের নিচতলায় এখনো পানি। ফাতেমা বেগম নামের (৩৫) এক নারী বললেন, ‘নয়জন মানুষ নিয়া আছি। খানি নাই, পানি নাই, রাইত অইলে অন্ধকার। আমরারে কেউ আইয়া দেখছে না।’

আরও পড়ুন

সকালে পৌর শহরের মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বনানীপাড়া, ষোলঘর, কাজীর পয়েন্ট, বিহারীর পয়েন্ট, হাসপাতাল, সড়ক ধরে ময়নার পয়েন্ট, হুসেন বখত চত্বর, মমিনুল মউজদীন সড়ক, ডিএস রোড হয়ে আলফাত স্কয়ারে হেঁটে আসতে এই প্রতিবেদকের প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এসব সড়কের কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপানি ছিল। সড়কের দুই পাশে অসংখ্য বাড়িঘর, সরকারি–বেসরকারি অফিস, দোকানপাট প্লাবিত হতে দেখা গেছে। শহরের বেশি পানি নতুনপাড়া, হাজীপাড়া, সুলতানপুর, কালীপুর, হাসননগর, বড়পাড়া, মোহাম্মদপুর, সুলতানপুর, মরাটিলা, তেঘরিয়া এলাকায়।

বন্যার পানি কমায় মধ্য শহরের দু–একটি এলাকায় গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে যান চলাচল। দু–একটি দূরপাল্লার বাসও সুনামগঞ্জ থেকে ছেড়ে গেছে। তবে জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে পানির ওপর কয়েকটি বেঞ্চ বসিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছেন রিকশাচালক ইয়াকুব আলী (৬০)। বেঞ্চের ওপরই রান্নাবান্না করছিলেন তাঁর স্ত্রী বৃষ্টি বেগম (৪০)। এই দম্পতি জানালেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে ছিলেন। শুক্রবার রাতে একজনের দেওয়া কিছু চিড়া চিবিয়েছিলেন। এখনো কোনো ত্রাণ পাননি বলে জানান তাঁরা।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে। জেলায় এ পর্যন্ত ৭৮০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৮০ লাখ টাকা, প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার ১০ হাজার বস্তা খাদ্যসামগ্রী এবং শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় জেলাজুড়ে ত্রাণ বিতরণ চলছে।

হাসপাতাল রোড ধরে যেতে যেতে পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনের বাসভবন, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে হাঁটুপানি দেখা গেল। এই পানি ভেঙে দুজন সহকর্মীকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সিভিল সার্জন মো. আহম্মদ হোসেন। জানালেন, জেলা সদর, শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলা হাসপাতাল ছাড়া আর সব কটি হাসাপাতাল প্লাবিত। তবে কোথাও সেবা কার্যত্রম বন্ধ হয়নি।

সব হাসপাতালে রোগীর পাশাপাশি বন্যার্তরা আশ্রয় নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আটতলা ভবনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। রোগী আর বন্যার্ত মানুষে ঠাসা। ছয়তলা পর্যন্ত সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে টেকা দায়। প্রতিটি তলায় অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসেছেন কেউ কেউ। অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। হাসপাতালেও বিদ্যুৎ নেই।

হাসননগর এলাকার বাসিন্দা প্রবীণ আইনজীবী ও লেখক হোসেন তওফিক চৌধুরী (৭৯) বলেন, ‘৭৪, ৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যা দেখেছি। এত ব্যাপক বন্যা সুনামগঞ্জে আগে কখনো হয়নি। এটা মহাদুর্যোগ। এমন দুর্যোগে মানুষ প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছে না। মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।’

দু–এক দিনের মধ্যে পৌরসভার পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত। শহরে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে জানিয়ে মেয়র বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। তবে পৌঁছাতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিন এক হাজার মানুষের খিচুড়ি রান্না করে আশ্রয়কেন্দ্রে বিতরণ করা হচ্ছে পৌরসভার পক্ষ থেকে।