গুরুত্ব পাবে অবৈধ প্রবাসীদের ফেরানোর আলোচনা

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর বিষয়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গুনার উইগান্ড

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোতে অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীদের ফেরানোসহ তাঁদের পরিচয় যাচাইয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেনি। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে ইউরোপীয় কমিশন বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে কড়াকড়ি আরোপের সুপারিশ করেছিল। তবে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যেন এই ধারা অব্যাহত রাখে সেটি দেখতে চায় ইইউ। ব্রাসেলসে আগামীকাল মঙ্গলবার ইইউ ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সংলাপের আলোচ্যসূচিতে এ বিষয়টি ইইউর অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে অগ্রগতি অব্যাহত রাখার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করবে।

চতুর্থ এই কূটনৈতিক সংলাপে বাংলাদেশ ইউরোপের ২৭-দেশের জোটের সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত সম্পর্কে নেওয়ার ওপর জোর দেবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে চিরাচরিত উন্নয়ন সহযোগিতা ও ব্যবসা বিনিয়োগের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারণের বিষয়টি সামনে আনবে।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় এই কূটনৈতিক সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর বিষয়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গুনার উইগান্ড ইইউর নেতৃত্ব দেবেন।

ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলি সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় আইপিএস নিয়ে ২৭ দেশের জোটের আগ্রহের বিষয়টি জানিয়েছেন
ছবি: সংগৃহীত

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চলমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে এক ধরনের প্রতিযোগিতা জোরদার হচ্ছে। এরই প্রেক্ষাপটে জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নও সম্প্রতি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের বিষয়ে তাদের অবস্থানগত কৌশল (আইপিএস) ঘোষণা করেছে। ফলে আসন্ন কূটনৈতিক সংলাপে আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইবে ইইউ। পাশাপাশি নিজেদের অবস্থানের বিষয়টি আরও বিস্তারিত তুলে ধরতে পারে বাংলাদেশের কাছে।

ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর নতুন রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলিও আইপিএস নিয়ে ২৭ দেশের জোটের আগ্রহের বিষয়টি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের এরইমধ্যে জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ককে ইইউ এখন কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত করতে আগ্রহী।

বৈঠকের আলোচ্যসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এবারের আলোচনায় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ইইউর নতুন উন্নয়ন সহায়তার বাজেট (প্রায় ছয় শ মিলিয়ন ইউরো), কর্ম পরিবেশের নিরাপত্তাসহ বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার স্বার্থে প্রতিশ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অগ্রগতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের নানা বিষয় নিয়ে এক দিনের বৈঠকে আলোচনা হবে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপিয়ান বিনিয়োগ ব্যাংক এরইমধ্যে এশিয়া মহাদেশের সংযুক্তির বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জলবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ ও সঞ্চালন লাইন প্রতিষ্ঠার মতো প্রকল্পে নিয়ে এবারের কূটনৈতিক সংলাপে ইইউ আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত শনিবার প্রথম আলোকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশক পূর্তি এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সন্ধিক্ষণে এই বৈঠক হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে চায়। ইইউ এরইমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে পরের ধাপে উন্নীত করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চিরায়ত ধারায় আটকে না থেকে সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে জনস্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, সংযুক্তি ও নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেব।

এসওপির বাস্তবায়ন ও আইপিএসে অগ্রাধিকার দেবে ইইউ

ইউরোপে অবৈধ হয়ে পড়া লোকজনকে ফেরাতে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মানসম্মত কার্যপ্রণালী বিধি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি) সই করে। বাংলাদেশ ইউরোপে অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীদের ফেরাতে দ্রুতগতির পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে অসন্তোষ তৈরি করেছে। তারা এ বিষয়ে কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে অবৈধদের ফেরানোর কার্যক্রমে গতি আনতে ইউরোপীয় কমিশন গত ১৫ জুলাই সাময়িকভাবে বাংলাদেশিদের ভিসায় কড়াকড়ির সুপারিশ করে। অবশ্য কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ, নতুন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াসহ নানা বিষয়ে প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি বলে উল্লেখ করে। তবে গত তিন থেকে চার মাসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সম্পর্কে অভিযোগকারী দেশ জার্মানি, গ্রিস, মাল্টা ও অস্ট্রিয়া এবার তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে।

তবে বাংলাদেশ যেন উন্নতির এই ধারা অব্যাহত রাখে তাতে জোর দিচ্ছে ইইউ। তাই ব্রাসেলস বৈঠকের ঠিক আগেভাগে ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলি ইউরোপের একাধিক রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ইউরোপের রাষ্ট্রদূতেরা এসওপি বাস্তবায়নের ধারা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। এ সময় তাঁরা জানিয়েছেন, ব্রাসেলসের আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।

ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সংলাপে আইপিএসের বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, যেহেতু ইইউ সম্প্রতি তাদের আইপিএস নীতি চূড়ান্ত করেছে তাই তারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি আমাদের অবস্থান জানতে চাইবে। আমরা এ থেকে কীভাবে লাভবান হতে পারি, কীভাবে আমরা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারি এবং আমাদের প্রত্যাশা কী সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।

ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বৈরথকে বিবেচনায় নিয়ে ইইউর আইপিএস কৌশলে চীনকে বাদ দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতায় নিজেদের জড়ায়নি ইইউ। ফলে এটি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অবাধ ও মুক্ত থাকার নীতির প্রতি নিজেদের আস্থা তুলে ধরেছে।