গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নাম গায়েব (বাকী অংশ)

প্রথম অংশের পর:

জিয়াউদ্দীন তখন চট্টগ্রামের একজন ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তা। তিনি জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুর দুজনকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। প্রথম জন খুন হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে ও দ্বিতীয় জন ১৯৮১ সালের ১ জুন। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর ভালো সূত্র ছিল। তাঁর বইটিতে তিনি এই দুই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন। বইটির নাম অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড ইট্স্ আফটারম্যাথ।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত লেখাটিতে আমরা দেখেছি, জিয়াউদ্দীনের সূত্র তাঁকে জানিয়েছে যে, মঞ্জুর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভেতরে সেনা হেফাজতে থাকাকালে হত্যার শিকার হয়েছেন। ঢাকা থেকে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসা একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা তাঁকে খুন করেন।

মঞ্জুুর যে ঘরে বন্দী ছিলেন, কীভাবে সেই কর্মকর্তা সেখানে প্রবেশ করেন, জিয়াউদ্দীন সেটি তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন। জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘তিনি [ঢাকা থেকে আগত] মঞ্জুরের ঘরে প্রবেশ করেন। মঞ্জুরের দিকে পিস্তল তাক করে গুলি করেন ও এরপর বেরিয়ে যান। সবকিছু একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে।’
জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত্ ঢাকায় ১৯৭০ সালে, আমাদের এক অভিন্ন বন্ধুর ফ্ল্যাটে। এরপর তাঁর বই নিয়ে আলোচনা করার জন্য ২০১৪ সালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার আগ পর্যন্ত আমাদের আর দেখা-সাক্ষাত্ বা কথাবার্তা হয়নি। তবে ২০১৪ সালে জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত একটি সূত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে ব্যক্তি নিজেকে মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী বলে দাবি করেন। সামরিক সূত্র জিয়াউদ্দীনকে যে বিবরণ দিয়েছিল, সেটির সঙ্গে তাঁর বিবরণ অনেকাংশে মিলে যায়।
১ জুন ১৯৮১ রাতের বেলা আমার প্রথম সূত্র চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হাজির ছিলেন। তিনি দেখেছেন, জেনারেল মঞ্জুরকে সেনানিবাসে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা হয় এবং পরে ভিআইপি গেস্ট হাউসে আটকে রাখা হয়। আমার সূত্র জেনারেল মঞ্জুরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তিনি তাঁকে তক্ষুনি চিনে ফেলেন।
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পরই এই ব্যক্তি সেনানিবাসে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন মেজর জেনারেলকে সেনানিবাসে দেখতে পান। সেই কর্মকর্তা ছিলেন মূলত ঢাকাভিত্তিক। আমার সূত্র তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারেন। কারণ, কর্মকর্তাটির সঙ্গে এই ব্যক্তির আগেও বার কয়েক দেখা হয়েছে। আমার সূত্রটি এ দাবিও করেছেন যে, মঞ্জুরকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল, এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেই ভিআইপি গেস্ট হাউসে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে কিছুক্ষণের জন্য ছিলেন। এরপর তিনি দ্রুতগতিতে সেই গেস্ট হাউস ও সেনানিবাস ত্যাগ করেন।
আমার সূত্র আরও দাবি করেছেন, যে ঘরে মঞ্জুরকে আটকে রাখা হয়, তিনি সেখানে ঢুকেছিলেন। মঞ্জুরের মাথায় একটিমাত্র গুলি করা হয়েছিল, তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। জেনারেলকে খুন করা হয়েছে। আরও অনেকেই সে ঘরে ঢুকেছিলেন, তাঁরাও একই দৃশ্য দেখেন।
যে বড় কর্মকর্তা মঞ্জুরের ঘরে ঢুকেছিলেন, তাঁর নামও আমার সূত্র আমাকে জানিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আমার চার পর্বের রচনার দ্বিতীয় অংশে আমি উল্লেখ করেছিলাম, কেন আমার পক্ষে তাঁর নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, এই মামলার কৌঁসুলিদের উচিত এই চাক্ষুষ সাক্ষীর পরিচয় গোপন রেখে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ করা।
আমি সিরিয়ায় আসাদের আমলের নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের একজন সাক্ষীর উদাহরণ দিয়েছিলাম। আমি দেখিয়েছিলাম, কীভাবে সেই ব্যক্তির পরিচয় গোপন রেখে তদন্তকারীরা তাঁর সাক্ষ্য নিয়েছেন এবং তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সেই ব্যক্তি ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী বিশেষ সামরিক ডকুমেন্টেশন ইউনিটের সদস্য ছিলেন। তাঁরা ফ্ল্যাশ ড্রাইভে নির্যাতনের কয়েক হাজার ছবি নিয়ে সিরিয়া ত্যাগ করেছিলেন।
আমার পরামর্শ ছিল, বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলোও একই রকমভাবে একটি কাঠামো গড়ে তুলুক, যাতে কোনো সাক্ষী চাইলে বাংলাদেশের বাইরে থেকে সাক্ষ্য দিতে পারেন। পরিচয় গোপন এবং নিরাপত্তা অটুট রাখা হবে, এমন আস্থা অনুভব করলে কোনো সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য কিছুটা কাজে লাগতে পারে।
(সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দীর ভাষ্যে শুধু বানান ও ভাষাগত পরিমার্জনা করা হয়েছে)

লরেন্স লিফশুলত্জ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ (হংকং)-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?