নিরাপদ সড়কের সঙ্গে ন্যায়বিচারের সম্পর্ক রয়েছে: সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হওয়ার মামলার রায় হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে যে আমরা এসব ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি না, প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা।

তারপরও কিছু ঘটনা আমাদের আলোড়িত করে, বিচলিত করে। আমরা উদ্বিগ্ন হই। তখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বাধ্য হই। সে রকম ছিল রাজীব ও দিয়ার মৃত্যুর ঘটনা। ওই ঘটনা দেশবাসীকে এতটাই ক্ষুব্ধ করে যে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। এই ঘটনার আগেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রকট আকার ধারণ করে।

দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ সড়কের জন্য নানা আন্দোলন হয়ে আসছিল। সরকার তাতে খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছে বলে প্রমাণ পাইনি। কিন্তু স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ‘নিরাপদ সড়ক চাই, ন্যায়বিচার চাই’ বলে আন্দোলন শুরু করল। তারা স্মরণ করিয়ে দিল যে নিরাপদ সড়কের সঙ্গে ন্যায়বিচারের সম্পর্ক রয়েছে।

বিচারহীনতার কারণে সড়কে বেপরোয়া যানবাহন চালনার দাপট ব্যাপক আকার ধারণ করার জের ধরে দিয়া-রাজীব মৃত্যুবরণ করল। তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে নিশ্চয়, কিন্তু প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় যে ১০-১২ জন মারা যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন কি হলো? মহামারির চেয়ে অধিক সংখ্যায় বাংলাদেশের মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এটা সর্বজনবিদিত।

এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনেক কালক্ষেপণ করে সরকার শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত সড়ক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করল। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর কিছু ধারা-উপধারায় সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নিষ্ঠুর ‘মৃত্যুর মিছিল’ চলতে থাকলেও যারা সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ভূমিকায় রয়েছে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই আইন না মানার ঘোষণা দিয়ে এটি অকার্যকর করার চেষ্টা করল। এখানে সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা, যিনি সাবেক মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও জড়িত হলেন।

সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং জনগণের নিরাপদে চলার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। সেটা সুশাসনের একটি মৌলিক উপাদান। এখন প্রশ্ন তুলতেই হয়, যারা অন্যায়ভাবে শক্তি প্রদর্শন করতে পারে, তাদের কাছে কি সরকারের এমনভাবে নতি স্বীকার করতেই হবে?

আন্দোলনকারী ছাত্রদের থামিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার নিজেও চেষ্টা করেছে। সরকারের হয়ে ‘হেলমেট বাহিনী’ নামে একটি দল আন্দোলনকারীদের ওপর নানাভাবে আক্রমণ করেছে। বিক্ষোভরত ছাত্ররা আন্দোলন ফেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

গতকাল সেই সড়ক দুর্ঘটনা মামলার রায় ঘোষিত হলো। শাস্তি হিসেবে এটি যথেষ্ট কড়া। মহামান্য আদালত যতটুকু শাস্তি দেওয়া সমীচীন মনে করেছেন, তা প্রদান করেছেন। আমরা বলতে পারি এ ঘটনার একটা বিচার পাওয়া গেল।

কিন্তু যে প্রশ্ন থেকেই গেল, তা হলো সরকার সুশাসনের প্রশ্নে অশুভ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করল কি না। আমরা একটা দুর্ঘটনার বিচার পেলাম। কিন্তু আমরা শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তো আন্দোলন করি না। আবারও স্মরণ করি কোমলমতি ছাত্রদের কথা, যারা পরিষ্কারভাবে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা দাবি করেছিল।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারবে, তার দৈনন্দিন কাজকর্ম সমাধান করতে পারবে—দিয়া এবং রাজীবকে হারানোর অভিজ্ঞতার কারণে এসব বিষয় নিশ্চিত করার টেকসই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য কোনো উদ্যোগ দেখতে পেলাম কি না। আমরা চাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সড়কের নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপগুলো নেবে এবং জনবিরোধী, স্বার্থান্বেষী ও অগণতান্ত্রিক আসুরিক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। তারা যাতে পড়াশোনাসহ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হোক। একটা নিরাপদ মানবিক সমাজ গঠনে যার যার অবস্থান থেকে আমাদের যে ভূমিকা আছে আমরা যেন তা পালন করি এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় সব আইনকানুন, শৃঙ্খলার সমর্থনে সোচ্চার হই।

সুলতানা কামাল: মানবাধিকারকর্মী