বাংলাদেশ সরকার গঠন

বিশিষ্ট আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম।

আমরা একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করলাম। কেননা, ভারত সরকারের সঙ্গে একটি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কথা বলা উচিত। তাজউদ্দীন ভাই (তাজউদ্দীন আহমদ) জিজ্ঞাসা করেন, কাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে? আমি বললাম, যে পাঁচজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন, এই পাঁচজনকে নিয়েই সরকার গঠন করা হবে। দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু, সাধারণ সম্পাদক ও তিনজন সহসভাপতি নিয়ে এই হাইকমান্ড আগেই গঠিত হয়েছিল।

তাজউদ্দীন ভাই পুনরায় প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? দ্বিধা না করে এবারও জবাব দিলাম, ২৫ মার্চের পর থেকে আজ পর্যন্ত যিনি প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তিনিই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন ভাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করতেন। তাই আমি যখন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করি, তখন এই প্রস্তাব মেনে নিতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল।

আমাদের আরও চিন্তা হলো, বঙ্গবন্ধুকে সরকারের প্রধান করা হলে আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া হবে। অথবা তাঁর জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ দেখা দেবে কি না। তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। তবে এই ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত, যেকোনো প্রকার ভয়ভীতি বা চাপের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কোনো বিবৃতি দিতে সমর্থ হবে না।’

তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করতে হবে, তিনি সমস্ত বক্তৃতা নিজেই হাতে লিখে নিলেন। পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়।

আমরা বিমানে করে আবার কলকাতা ফিরে এলাম। জানলাম, মনসুর ভাই (ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী) ও কামারুজ্জামান (এ এইচ এম কামারুজ্জামান) এসেছেন। তাঁদের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। খবর নিয়ে জানলাম, কলকাতায় গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে কামারুজ্জামান ভাই থাকেন। আমি ও তাজউদ্দীন ভাই কামারুজ্জামান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা তাঁর কাছে এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করি। কামারুজ্জামান ভাইয়ের মনে একটা জিনিস ঢোকানো হয়েছে যে আমরা তাড়াহুড়ো করে দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছি। নেতাদের জন্য অপেক্ষা করা আমাদের উচিত ছিল।

কামারুজ্জামান ভাই খুবই সুবিবেচক মানুষ। তিনি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বললেন। রাতে লর্ড সিনহা রোডে আমাদের বৈঠক বসল। উপস্থিত বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন কামারুজ্জামান, মিজান চৌধুরী, শেখ মনি (শেখ ফজলুল হক মনি), তোফায়েল আহমেদ ও আরও অনেকে। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী, বাংলার যুবকেরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোনো মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী-মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।

তাজউদ্দীন ভাই ও আমি ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই শেখ মনির বক্তব্য সমর্থন করেন। তাজউদ্দীন ভাই যেহেতু নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তাঁর পক্ষে পাল্টা জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হলো। সভার শেষ পর্যায়ে তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা দেন। উপস্থিত সবাই সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য মেনে নিলেন।

১০ এপ্রিল। বিমানে আমাদের আগরতলা রওনা হওয়ার কথা। তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আমি লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দরে যাই। আমরা বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে জিপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভেতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলোতে উঠলাম। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী, এখানে কোনো একটি জঙ্গল থেকে গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারিত হবে।

মনসুর ভাইয়ের জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন, তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোনো আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামারুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদের ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন তোলেননি।

পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সঙ্গে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে কোনো আপত্তি করবেন না। তা ছাড়া তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইল খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন। তবু চারজন এক থাকলে মোশতাক ভাইকেও রাজি করানো যাবে।

এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দীন ভাই প্রচারের জন্য অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেওয়া হলো।

১০ এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাবার টেবিলে তাজউদ্দীন ভাই ও শেখ মনি আছেন। রাত তখন সাড়ে নয়টা। সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এল। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে এল। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা দেবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্ব শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।

রাতে খাওয়ার পর নেতারা বৈঠকে বসেন। খন্দকার (মোশতাক) খুবই মনঃক্ষুণ্ন। টি হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলো, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। উপস্থিত সবাই একবাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন।

ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ড. টি হোসেন ঢাকা থেকে তাঁকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েক দিন আগে আগরতলায় এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তা ছাড়া সেখানে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।

রাতে খাওয়ার পর নেতারা বৈঠকে বসেন। খন্দকার (মোশতাক) খুবই মনঃক্ষুণ্ন। টি হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলো, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। উপস্থিত সবাই একবাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন।

সবাই জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েক দিন আগে পবিত্র হজব্রত পালন করে এসেছেন। তাঁর মাথায় তখনো মক্কা শরিফের টুপি। তিনি আধা ঘণ্টা ধরে আবেগপ্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম।

স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দীন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, বৈঠকে সব কটির অনুমোদন দেওয়া হয়।

১৩ এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতায় ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফের চট্টোপাধ্যায় জানতাম।

অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী প্রথম যে ভাষণ দেন, তার কপি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল। ইংরেজি কপি বিদেশি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন।

১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী।

* আমীর-উল ইসলাম: প্রথিতযশা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী

(সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আমীর-উল ইসলাম, কাগজ প্রকাশনা, ১৯৯১)