ব্রেইল পদ্ধতিতে আগ্রহ কমছে

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও থেমে নেই পড়াশোনা। বাবা রাশেদুর রহমানের সঙ্গে ব্রেইল বই পড়ছেন অষ্টম শ্রণির ছাত্রী তাসনিম বিনতে রাশেদা। গতকাল মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকা।ছবি: হাসান রাজা

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাশেদুর রহমান রাজধানীতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করছেন। তাঁর দশম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়েও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁর ছোট মেয়ে ব্রেইলে ভালো। তবে বড় মেয়ের ব্রেইলে তেমন আগ্রহ নেই।

বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে ডিজিটাল বই পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি, ব্রেইল পদ্ধতির শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে এ পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ কমছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। তবে তাদের অভিভাবক ও ব্রেইল নিয়ে কাজ করা কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ব্রেইল পদ্ধতি শেখার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে ডিজিটাল বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এতে একজন শিক্ষার্থী বানান-ব্যাকরণ শেখার সুযোগ পাচ্ছে না। এতে একধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে।

ব্রেইলের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে রাশেদুর রহমান বলেন, ‘ব্রেইল না জেনে পড়াশোনা আর তোতা পাখির বোলের মধ্যে কোনো তফাত নেই। নদী বানানে ই-কার না ঈ-কার তা শিখতে হলে তাকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়তেই হবে।’

রাজধানীর মিরপুরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের (পিএসটি সেন্টার) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক কল্পনা আক্তার ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বললেন, যাদের চোখে দৃষ্টি আছে, তারা যখন একটি বই পড়ে, তা তাদের চোখে ভাসে বা ভালোভাবে মনে থাকে। ব্রেইল বইটাও একই কাজ করে। হাত দিয়ে ধরে ধরে পড়ে বলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরও পড়াটা মনে থাকে। বুঝে পড়তে পারে।

৬৪ জেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ৬৪টি স্কুলে ১০টি করে আসন আছে। প্রতিটি স্কুলে একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘রিসোর্স শিক্ষক’–এর তত্ত্বাবধানে শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন চট্টগ্রামের ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সংগৃহীত তথ্য বলছে, মাত্র ৩২টি স্কুলে রিসোর্স শিক্ষক আছেন।

৬৪ জেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ৬৪টি স্কুলে ১০টি করে আসন আছে। প্রতিটি স্কুলে একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘রিসোর্স শিক্ষক’–এর তত্ত্বাবধানে শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন চট্টগ্রামের ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সংগৃহীত তথ্য বলছে, মাত্র ৩২টি স্কুলে রিসোর্স শিক্ষক আছেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নুরুল বাসিরও জানালেন, রিসোর্স শিক্ষক বা জনবলস্বল্পতা আছে।

গাজীপুরের টঙ্গীতে সরকারের একমাত্র ব্রেইল প্রেসের তিনটি মেশিনই নষ্ট। নষ্ট মেশিন মেরামত করে কাজ চালাতে হচ্ছে। প্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ফখরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মেশিন নষ্ট থাকার কারণে সরকারের ব্রেইল পাঠ্যবই প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ বই প্রকাশ করছে।

ব্রেইল প্রকাশনার মাধ্যমে একুশে বইমেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের ব্রেইল বই পাচ্ছেন বিনা মূল্যে। স্পর্শ ব্রেইল প্রেসের প্রধান উদ্যোক্তা এবং স্পর্শ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট নাজিয়া জাবীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকে ব্রেইল বই নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ছিল, তা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। শিশুদের দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে আগে ভালো করে ব্রেইল শেখাতে হবে।

ব্রেইল বই পড়ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাশেদুর রহমান। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে তাঁর বাসায়।
ছবি: প্রথম আলো

২০১৪ সাল থেকে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক পড়ারও সুযোগ পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের আওতায় ইপসা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়ার উপযোগী করে ‘ডেইজি মাল্টিমিডিয়া বই’ তৈরি করেছে।

এটুআইর জাতীয় পরামর্শক (প্রবেশগম্যতা) ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তবে মাল্টিমিডিয়া টকিং বুককেও বাড়তি সুযোগ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারছে।’

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ব্রেইল পাঠ্যবই ছাপানোসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করছে। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান বলেন, পঞ্চাশের দশকের পর বাংলা ব্রেইলের আর হালনাগাদ করা হয়নি। এটি হালনাগাদ করা জরুরি।

ব্রেইল পদ্ধতির বিভিন্ন সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু প্রথম আলোকে বলেন, ব্রেইলসহ প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর আছে। মন্ত্রণালয়ও আস্তে আস্তে বিভিন্ন কাজ করছে।