মহাসড়কে মোটরসাইকেল: এ যেন ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা

শুভ্র সেন
ছবি: সংগৃহীত

দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ছে। দেশে কারখানা হওয়ার পর দাম কমেছে। গণপরিবহনের অভাবে ভুগতে থাকা মানুষ মোটরসাইকেলকে দৈনন্দিন চলাচলের একটি সাশ্রয়ী মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে।

সরকার মোটরসাইকেলশিল্পকে এগিয়ে নিতে যখন নানা নীতি সহায়তা দিচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের সুপারিশ করছে। তাদের বক্তব্য হলো, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এ সুপারিশ করা হয়েছে। এ যেন ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা।

আমরা জানতে চাই, আজ পর্যন্ত বিআরটিএ বাইকারদের জন্য কী করেছে? বাইকারদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, কোনো সঠিক নির্দেশিকা বা গাইডলাইন নেই, যাঁরা মোটরসাইকেল চালানো শেখান, সেই প্রশিক্ষক বা ইনস্ট্রাক্টরদের জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থাও নেই। আমার জানামতে, যাঁরা চার চাকার যানবাহন চালাবেন, তাঁদের প্রশিক্ষকদের জন্য শুধু লাইসেন্সের ব্যবস্থা আছে।

যেখানে গোড়ায় গলদ, সেখানে তো দুর্ঘটনা বেশি হবেই। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে নির্দেশিকা তৈরির দাবি করে আসছি।

এক.

একসঙ্গে ১৬৫ সিসি পর্যন্ত ইঞ্জিনক্ষমতার মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স না দিয়ে প্রথমে ১০০ বা ১২৫ সিসি পর্যন্ত ক্ষমতার মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স দিতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময় অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ১৫০ বা তার বেশি সিসির মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হোক। দুর্ঘটনায় বেশি মারা যান ১৮ থেকে ২৪ বছরের তরুণেরা। যার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত গতি, নিয়ম না মানা ও অনভিজ্ঞতা।

দুই.

মোটরসাইকেল চালানো শেখাতে ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে এবং বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইনস্ট্রাক্টরদের লাইসেন্স দিন, লার্নিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।

তিন.

ভিয়েতনামে প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু দুর্ঘটনা অনেক কম। সেখানে দুর্ঘটনা কেন কম, সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করুন। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশেও দুর্ঘটনা কমবে।

আরও পড়ুন

চার.

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম হচ্ছে ভালো মানের হেলমেট। বাংলাদেশে হেলমেটের নামে প্লাস্টিকের বাটি বিক্রি হচ্ছে। সেগুলোর কোনো মান পরীক্ষা হয় না। যদিও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক মান পরীক্ষার তালিকায় হেলমেট রয়েছে। কিন্তু তারা মান পরীক্ষা করে না।

আন্তর্জাতিকভাবে ডট, ইসিই, স্নেল সার্টিফায়েড হেলমেট যেমন আছে, তেমনি পাশের দেশ ভারতে আইএসআই সার্টিফায়েড হেলমেট বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে বিএসটিআই সনদপ্রাপ্ত হেলমেট বিক্রি বাধ্যতামূলক করা দরকার।

পাঁচ.

দেশে ৫৫০টির বেশি বাইক ও বাইকিং ক্লাব অথবা গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি বাইকিং গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে বিআরটিএর স্থানীয় কার্যালয় থেকে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো দরকার। আমরা বাইকাররা খুশিমনে এগিয়ে আসব।

গত ঈদুল ফিতরে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বাড়ে কয়েক গুণ, বেড়েছে দুর্ঘটনাও
ফাইল ছবি

৫০ লাখের বেশি বাইকার প্রত্যক্ষভাবে মোটরসাইকেলের সঙ্গে জড়িত। গত ঈদে বাইক নিয়ে ঈদযাত্রা করে বাইকাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন জ্যামবিহীন বা ভোগান্তিবিহীন ঈদযাত্রা সম্ভব।

আরও পড়ুন

ছয়.

কেউ যাতে লাইসেন্স ছাড়া, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকায় এখন হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো কঠিন। জরিমানার মুখে পড়তে হয়। সারা দেশে কেন এটা নিশ্চিত করা হবে না। পুলিশকে এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। আমরা চাই সরকার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে সার্বিক একটি উদ্যোগ নিক।

সাত.

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এটা একা বিআরটিএর পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, বাইকারদের প্রশিক্ষিত ও সচেতন করতে মনোযোগী হোন। উদ্ভট সুপারিশ করে নিজেদের সবার সামনে হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকুন।

মানুষের জন্য একটি সহজ যান হলো মোটরসাইকেল। গণপরিবহনের অভাবে শহরে মানুষ মোটরসাইকেল কিনতে বাধ্য হয়। বাসমালিকেরা যখন টিকিটের চড়া দাম হাঁকেন, তখন মানুষ মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামে রওনা দেয়। এটা জীবন ও জীবিকার একটি উপায়ও বটে। আসুন সবাই নিয়মে মেনে মোটরসাইকেল চালাই।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), বাইকবিডিডটকম