সরকারে যে–ই আসে গণমাধ্যমকে আঘাত করে, এখন মাত্রাটা অসহনীয়

জাতীয় প্রেসক্লাবে গতকাল বিএনপি আয়োজিত ‘গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

যত দিন যাচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। কারণ, সরকারে যে–ই আসে, তারা কোনো না কোনোভাবে গণমাধ্যমকে আঘাত করে। কিন্তু এখন মাত্রাটা অসহনীয়, সীমাছাড়া।

আজ রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সরকার প্রণীত গণমাধ্যমবিষয়ক বিভিন্ন আইন সম্পর্কে এক মতবিনিময় সভায় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতারা এ কথাগুলো বলেন।

বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। স্বাগত বক্তব্যে তিনি গণমাধ্যমবিষয়ক বর্তমান সরকারের চারটি আইনকে স্বাধীন গণমাধ্যমের কফিনে শেষ পেরেক বলে মন্তব্য করে বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে এসব আইন করা হয়েছে।

পরে অন্য আলোচকদের কেউ কেউ অতীতে বিএনপি সরকারের সময় সাংবাদিক দলন ও নিগ্রহের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন। প্রায় সব আলোচকই গণমাধ্যম নিয়ে বিএনপির এখনকার উপলব্ধির জন্য সাধুবাদ জানান এবং ক্ষমতায় গেলে এটি যেন ভুলে না যায়, সে ব্যাপারে সতর্ক করেন। তবে তাঁরা এ–ও বলেন, এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্রের মুক্তি।

সমাপনী বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমাদের পরিষ্কার ঘোষণা, আমরা সরকারে গেলে মুক্ত গণমাধ্যমের অন্তরায় “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট”সহ সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করব।

প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা ও পরিসর বৃদ্ধি, গণমাধ্যমকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা, গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইন করা হবে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আজকে গোটা জাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই জাতি বা রাষ্ট্রকে উদ্ধারে একটি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি করতে না পারলে এখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের বিজয় অবশ্যই অর্জিত হবে।’

মতবিনিময় সভায় ‘গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন।

সম্প্রতি ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’ প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রবন্ধে বলা হয়, বিষয়টি লজ্জার। এর পেছনে নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশগুলো দায়ী। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-২০১২, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও নীতিমালা-২০২১, অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট প্রভৃতির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে এমনভাবে চেপে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে যে তারা শুধু সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

আমাদের পরিষ্কার ঘোষণা, আমরা সরকারে গেলে মুক্ত গণমাধ্যমের অন্তরায় ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’সহ সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করব—
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির মহাসচিব

মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ৪৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হন। এ ছাড়া হামলায় ১ হাজার ১৪০ সাংবাদিক গুরুতর আহত হন, ১৫২ জনের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে এবং ২১৪ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৯ সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।

মতবিনিময় সভায় প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে ক্ষমতায় গেলে কী কী করবেন, তার কিছু অঙ্গীকার আছে। তাদের অঙ্গীকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারি, আশ্বস্ত হওয়ারও চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমাদের অতীত আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয়, বর্তমান তো নয়ই।’
সোহরাব হাসান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমবান্ধব ছিল না, এখনো নেই। আজকে বর্তমান সরকারের নিবর্তনমূলক আইন, নিগ্রহ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অবিচার নিয়ে আমরা অবশ্যই কথা বলব। কারণ, আমাদের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব বাধা, সেগুলো দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের যেমন দায়িত্ব আছে, রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব আছে।’
এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ‘কিছু কিছু উদাহরণ ঐতিহাসিক কারণে তুলে ধরা উচিত।

এখানে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক, বাকশাল গঠনের আগপর্যন্ত এখানে সংবাদপত্রের মোটামুটি স্বাধীনতা ছিল। বাকশাল হওয়ার পর তারা চেয়েছে, সরকারি মতের বাইরে কিছুই চলবে না। বিএনপি এল, সামরিক শাসনের কথা বাদ দিলাম। বিএনপি যখন গণতান্ত্রিকভাবে চলার চেষ্টা করেছে, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিককে কিন্তু মানহানির মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল।’

সোহরাব হাসান বলেন, এই সরকার কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করেছে, এর নিন্দা করি। কিন্তু বিএনপির সময়েও একুশে টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অনেক সাংবাদিক এতে সহায়তা করেন। তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ যা করছে, তার সমালোচনা করব না, তার সমর্থন করব—সেটি নয়। অবশ্যই মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো আছে, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সমর্থন চাই, সহযোগিতা চাই। একই সঙ্গে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে চাই, তারা ক্ষমতায় গেলে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

যুগান্তর-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল বলেন, যখন একটি সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়, তখনই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিম্নগামী হয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা খুবই মারাত্মক। এর কারণটা হচ্ছে উইপেন অব ল অর্থাৎ আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।

সাংবাদিক সোহরাব হাসানের বক্তব্য খণ্ডন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, সাংবাদিক জহুর হোসেন কারাগারে যাননি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে তিনি জামিন নেন। আর একুশে টিভি বিএনপি সরকার বন্ধ করেনি। এটি টেরিস্টরিয়াল সম্প্রচারের ইস্যুতে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে বন্ধ হয়েছে।

এম আবদুল্লাহ বলেন, বিএনপির আমলে সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি, জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। ওই সময় সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এবং এটি চোরাকারবারিদের সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছিল। এখন ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, বিএনপির সময়ে সাংবাদিক দম্পতিকে বেডরুমে খুন করা হয়নি, প্রথম আলোর সম্পাদককে অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় হত্যার মামলা দেওয়া হয়নি, মাহ্‌ফুজ আনামের মতো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৭৯টি মামলা দেওয়া হয়নি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, ‘পুরো দেশটিই এখন একটা সিন্ডিকেটে পড়েছে। দেশে দেশপ্রেমিক সরকার না থাকলে গণমাধ্যমকে আমরা কখনোই মুক্ত করতে পারব না।’

বিএফএইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ বলেন, যত দিন যাচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। কারণ, সরকারে যে–ই আসে, তারা কোনো না কোনোভাবে গণমাধ্যমকে আঘাত করে। কিন্তু এখনকার মাত্রাটা অসহনীয়, সীমাছাড়া।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরীর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় আরও বক্তৃতা করেন সদ্য কারামুক্ত বিএফইউজের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, দিনকাল সম্পাদক রেজোয়ান সিদ্দিকী, সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, বিএফইউজের মহাসচিব নুরুল আমিন, সাংবাদিক এলাহী নেওয়াজ খান, বাকের হোসাইন, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, সরদার ফরিদ আহমদ, কাদের গনি চৌধুরী, ইলিয়াস খান, শহীদুল ইসলাম, ইলিয়াস হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, রফিকুল ইসলাম আজাদ, মুরসালিন নোমানী প্রমুখ।

সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।