হোশি কুনিও হত্যার দায়ে পাঁচ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড

.
.

রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যার দায়ে জেএমবির পাঁচ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ওই পাঁচজনের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার ১৭ মাস আগের চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তাঁর নাম আবু সাঈদ।
দেশে জঙ্গিদের হাতে কোনো বিদেশি হত্যার ঘটনায় এটাই প্রথম রায়। রায়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। জেএমবি ইসলামের নামে নৈরাজ্য, জঙ্গিবাদ ও নৃশংসতা করে থাকে। জঙ্গিদের এসব কর্মকাণ্ডে বিশ্ব ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা পায়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন (২১), সদস্য ইছাহাক আলী (২৫), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (২৩), সাখাওয়াত হোসেন (৩২) ও আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (২৪)। এঁদের মধ্যে আহসান উল্লাহ পলাতক রয়েছেন। তিনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাকি তিন আসামি মাসুদ রানা, ইছাহাক ও লিটন কারাগারে আছেন। তিনজনই আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
এই হত্যায় আরও দুজন সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে আসে। তাঁরা ইতিমধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এ ছাড়া বিজয় নামে আরেকজনের জড়িত থাকার তথ্য পেলেও পুলিশ তাঁকে শনাক্ত করতে পারেনি।
জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আসেন। তিনি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কাচু আলুটারি গ্রামে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে উন্নত মানের ঘাসের চাষ করতেন। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর ওই কাচু আলুটারি গ্রামে ৬৬ বছর বয়সী কুনিওকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ঢাকার গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যা র ওই ঘটনা তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যনমেও আলোড়ন তোলে। উভয় ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক) দায় স্বীকার করেছিল। যদিও বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দেয়। পরে অবশ্য পুলিশ কুনিও হত্যার জন্য নব্য জেএমবিকে দায়ী করে। আর সিজার তাবেলা হত্যায় বিএনপির একজন নেতাসহ কয়েকজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
কুনিও হত্যার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় কথিত নব্য জেএমবির জঙ্গিরা একের পর এক হিন্দু পুরোহিত, সাধু, খ্রিষ্টান যাজক, বৌদ্ধভিক্ষু, বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা, পীরের অনুসারী, মাজারের খাদেম, শিয়া অনুসারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের হত্যা করে। যার ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ও নৃশংসভাবে দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করে। যাঁদের সাতজন ছিলেন জাপানের নাগরিক।
কুনিও হত্যার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সকাল সাড়ে নয়টায় আদালতে আসেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি রায় পড়া শুরু করেন। তিনি ইংরেজিতে লেখা ৬২ পৃষ্ঠার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পড়ে শোনান।
রায়ে আসামি মাসুদ রানার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির একটি অংশ পড়ে শোনান বিচারক। সেখানে মাসুদ রানা বলেছেন, তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের সমর্থক ছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় জেএমবির নেতা মো. ইসহাক আলীর মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেন। ইসহাক আলী লিবিয়ায় কাজ করতে গিয়ে সেখানে মারা যান। জেএমবিতে যোগ দেওয়ার পর ‘ভালো কাজ’ করায় মাসুদ রানাকে পীরগাছা থানার সভাপতি করা হয়। তিনি তাঁর এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে দিন ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা। যারা ইসলাম ও শরিয়াহবিরোধী কাজ করত, তাদের তারা সঠিক পথে আসতে বলতেন। না এলে হুমকি দিতেন। তাদের হত্যার বিধান থাকলে হত্যা করতেন।
মাসুদ রানা জবানবন্দিতে বলেছেন, বিদেশি নাগরিকদের হত্যার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য হাইকমান্ডের নির্দেশ ছিল তাঁদের ওপর। এ দেশকে অস্থিতিশীল করলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ত। তখন দেশে ইসলামিক অভ্যুত্থান করা সহজ হতো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাসুদ রানা, সাদ্দাম, বিজয়, নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক হাসান ও আহসান উল্লাহ মিলে কুনিওকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনজন মোটরসাইকেলে গিয়ে কুনিওকে হত্যা করেন। এই হত্যার পর তাঁরা কয়েকজন মিলে রংপুরে বাহাই সম্প্রদায়ের এক নেতাকে হত্যার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তাঁরা ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর মাজারের খাদেম রহমত আলীকে হত্যা করেন। জবানবন্দিতে মাসুদ রানা আরও বলেন, পরে পত্রিকায় খবর পড়ে তিনি জানতে পারেন যে হোশি কুনিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তখন তাঁর খারাপ লাগে।
এরপর বিচারক ইছাহাক ও লিটনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির একটি অংশও পড়ে শোনান।
কুনিও মুসলমান ছিলেন এটা জানতে পেরে খারাপ লাগার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাসুদ রানা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে রায়ে বিচারক বলেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে এটা ধারণা করা যায় যে হোশি কুনিও যে মুসলমান এটা জানা থাকলে তাঁকে তাঁরা হত্যা করতেন না। মাসুদ রানা ইসলামের নামে তাঁর এই অভিব্যক্তি অথবা খেয়াল অথবা অনুতাপ দিয়ে ইসলামকে বিশ্বের কাছে জঙ্গিদের ধর্ম হিসেবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন। মুসলমানদের অমুসলমানদের চেয়ে বেশি মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন।
বিচারক বলেন, মাসুদ রানার জবানবন্দি অনুযায়ী তিনি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। পবিত্র কোরআন-হাদিস পড়েছেন। কিন্তু এটা প্রতীয়মান হয় যে তিনি ভুল দিকে ছিলেন। ভুল ব্যাখ্যার কারণে ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেক দূরে ছিলেন। কারণ, ইসলাম নিরীহ ব্যক্তির হত্যাকে সমর্থন করে না।
বিচারক বলেন, জেএমবি ইসলামের নামে নৈরাজ্য, জঙ্গিবাদ ও নৃশংসতা করে থাকে। এটা ইসলাম ও তার অনুসারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড; এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা পায়। কারণ, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। কোরআন ও সহিহ হাদিস শান্তিপূর্ণ ও সিভিলাইজড সমাজ গড়ার জন্য একটি আদর্শ জীবনধারার শিক্ষা দেয়। একজন নিরীহ ব্যক্তিকে বিনা কারণে হত্যাকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের নিয়ম না মেনে মাসুদ রানা বিপথগামী হয়েছেন।
বিচারক বলেন, তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও প্রাসঙ্গিক আইনে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, মাসুদ রানা, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া, সাখাওয়াত ও আহসান উল্লাহ আনসারীর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই হোশি কুনিওকে হত্যা করা হয়েছে। মাসুদ রানা, নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক হাসান (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) এবং অশনাক্তকৃত বিজয় মোটরসাইকেলে গিয়ে গুলি করে কুনিওকে হত্যা করেন।
রায় ঘোষণার পরপর বিচারক এজলাস ছেড়ে চলে যান। কাঠগড়ায় থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি ছিলেন স্বাভাবিক। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আসামি ইছাহাক আলী একসময় সুর করে ইসলামি সংগীত গেয়ে ওঠেন। অন্য তিনজন তাঁকে থামতে বললেও তিনি প্রিজন ভ্যানে ওঠা পর্যন্ত গেয়েই যান।
আসামিদের স্বজনদের মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে কেবল মাসুদ রানার স্ত্রী আলেমা বেগম তাঁর শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি রায়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর হোশি কুনিওকে হত্যার দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করেন। ওই রাতেই এই মামলায় কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির (হীরা) ও রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর এক মাস পর ১২ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসানকে (সুমন)। এ ছাড়া নওশাদ হোসেন রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল ও রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজলকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে গত বছরের ৩ জুলাই পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম না আসায় তাঁরা মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
গতকাল রায়ের পর এই মামলার সরকারপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি (পিপি) রথীশ চন্দ্র ভৌমিক সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে জেএমবির সদস্যরা বিদেশিদের হত্যার পরিকল্পনা করে। খুব কম সময়ের মধ্যে এই মামলার রায় হলো। সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক আসামিদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছেন।