
দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও প্রথম মুঠোফোন অপারেটর প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম (সিটিসেল) বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া পরিশোধে সিটিসেলকে বারবার সময় দেওয়ার পরও তারা বকেয়া পরিশোধ করেনি। তাই সিটিসেলের তরঙ্গ ও টাওয়ার ব্যবহার সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান আরও জানান, বিটিআরসির লাইসেন্সপ্রাপ্ত যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বকেয়া থাকলেই তাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিটিসেলের কাছে বিটিআরসির বকেয়ার পরিমাণ ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে টুজি লাইসেন্সের তরঙ্গ বরাদ্দ ও নবায়ন ফি বাবদ পাওনার পরিমাণ ২২৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজস্ব ভাগাভাগির ২৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, বার্ষিক তরঙ্গ ফি ২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের ৮ কোটি ৯২ লাখ লাখ, বার্ষিক লাইসেন্স ফি বাবদ ১০ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ ৩৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা ও বিলম্ব ফি বাবদ ১৩৫ কোটি ৭ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।
গ্রাহকসহ সিটিসেল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিটিআরসির পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। গতকাল এই বিজ্ঞপ্তিটি বিটিআরসির গণমাধ্যম বিভাগের ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধ না করে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া লাইসেন্সের শর্তের পরিপন্থী ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাজেই বিটিআরসি সিটিসেলের লাইসেন্স ও বেতার তরঙ্গ ব্যবহার বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। এমন অবস্থায় গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিকল্প ব্যবস্থা বা সেবা নেওয়ার জন্য ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হলো। সিটিসেল সংযোগ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের অসুবিধার জন্য বিটিআরসির পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
সিটিসেল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন ৬৫০ জন কর্মী। নিয়মিত বেতন না পাওয়া এমন একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এত দিন কয়েক মাস পরপর বেতন পেতাম। কার্যক্রম পুরো বন্ধ হয়ে গেলে বকেয়া বেতন পাব কি না, বুঝতে পারছি না।’
এ বিষয়ে জানতে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
টেলিযোগাযোগভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান বলেন, বকেয়া পরিশোধ করতে না পারার কারণে যদি সিটিসেল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে একই কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও টেলিটককেও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সিটিসেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে গ্রাহক, কর্মী, পরিবেশকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর স্বার্থ যাতে নিশ্চিত হয় সেই দায়িত্বও বিটিআরসিকে নিতে হবে।
১৯৮৯ সালে দেশের প্রথম মুঠোফোন অপারেটর হিসেবে টেলিযোগাযোগ সেবা দেওয়ার লাইসেন্স পায় সিটিসেল। যাত্রার সময় এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মুঠোফোন অপারেটর। প্রথম থেকে সিটিসেল বাংলাদেশের একমাত্র সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) মোবাইল অপারেটর হিসেবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুরুর দিকে সংযোগসহ সিটিসেলের একটি ফোনের দাম রাখা হতো লাখ টাকার বেশি।
সিডিএমএ প্রযুক্তির অপারেটর হিসেবে সিটিসেল ৯০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ ব্যবহার করে। সারা দেশে এই ব্যান্ডের ১০ মেগাহার্টজ ও ঢাকায় ৮ দশমিক ৮২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ সিটিসেলের কাছে এখন আছে। কাগজে-কলমে সিটিসেলের টাওয়ারের সংখ্যা ৮৫০-এর বেশি বলা হলেও বর্তমানে চালু থাকা টাওয়ারের সংখ্যা ২০০-এর কম বলে জানা গেছে।
সিটিসেলে বর্তমানে ৫৫ ভাগ শেয়ারের মালিক দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী প্যাসিফিক মোটরস ও ফার-ইস্ট টেলিকম। এর মধ্যে প্যাসিফিক মোটরসের শেয়ারের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর ফার-ইস্ট টেলিকমের ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিংটেল। প্যাসিফিক মোটরস ও ফার-ইস্ট টেলিকমের কর্ণধার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা মোর্শেদ খান।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে সিটিসেলের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। সিটিসেলকে ঋণ প্রদানকারী একটি অন্যতম ব্যাংক হলো আইএফআইসি। আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটিসেল আমাদের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রথমে জামানত বিক্রি করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করব। এভাবে না হলে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে পাওনা আদায়ের চেষ্টা করা হবে।’