মন্দা কাটিয়ে ব্যবসায় ফিরল বাবুরহাট

শেখেরচর-বাবুরহাটে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার দোকানে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, শার্ট ও প্যান্ট পিস, পাঞ্জাবিসহ দেশীয় সব কাপড়ের বেচাকেনা জমে উঠেছে।

নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাট কাপড়ের মোকাম আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ঈদ উপলক্ষে বেড়েছে ক্রেতাদের আনাগোনা। সাম্প্রতিক ছবিপ্রথম আলো

ঈদকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’খ্যাত কাপড়ের মোকাম নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাট। দেশের সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট হিসেবে পরিচিত এই মোকাম এরই মধ্যে দেশের নানা প্রান্তের পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।

শেখেরচর-বাবুরহাটে প্রতি বৃহস্পতি থেকে শনিবার—এই তিন দিন পাইকারি কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান। গামছা, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, শার্ট পিস, প্যান্ট পিস, পাঞ্জাবির কাপড়, থানকাপড়, বিছানার চাদরসহ দেশীয় সব ধরনের কাপড় পাওয়া যায় এই হাটে। এর ওপর এখানকার যোগাযোগব্যবস্থাও বেশ ভালো। সে জন্য সারা দেশ থেকে পাইকাররা এখানে এসে কাপড় কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তথ্য অনুযায়ী, এই জেলায় ছোট-বড় প্রায় তিন হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পাওয়ার লুম বা বৈদ্যুতিক তাঁত, টেক্সটাইল বা বস্ত্র ও ডাইং (সুতা ও কাপড় রং করা) কারখানাই বেশি। এসব কারখানায় কাজ করেন প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। দেশে দেশীয় কাপড়ের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশই মেটায় নরসিংদী ও এর আশপাশের জেলার কারখানাগুলো। আর এই কাপড়ই বিক্রি হয় এই বাবুরহাটে। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে বাবুরহাটের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার।

প্রায় পুরো নরসিংদী জেলাতেই রয়েছে সুতা থেকে কাপড় তৈরির পাওয়ার লুম তথা বৈদ্যুতিক তাঁতের কারখানা। এসব পাওয়ার লুমে দিনরাত খটখট শব্দ করতে করতেই সুতা থেকে গ্রে কাপড় তৈরি হয়। তখন গ্রে কাপড় বিভিন্ন ডাইং কারখানায় নিয়ে পছন্দ বা ফরমাশ অনুযায়ী রং করা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে এসব কাপড় নিয়ে আসা হয় বাবুরহাটে।

সরেজমিনে গিয়ে বাবুরহাটের অলিগলিজুড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা নানা বয়সী পাইকারি ক্রেতাদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। তারা এ দোকান-সে দোকান ঘুরে পছন্দমতো শাড়ি, লুঙ্গি ও থ্রি-পিসসহ নানা ধরনের কাপড় কিনে নিচ্ছেন। আবার ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকেই পাইকারি দামে জাকাতের কাপড় কিনছেন। বিক্রেতারা জানান, ঈদ উপলক্ষে বরাবরের মতো এবারও তাঁরা প্রচুর পরিমাণে নতুন নকশার কাপড় তুলেছেন।

পাইকারদের কেউ কেউ কাপড়ের গাঁট নিজেরাই মাথায়–কাঁধে বা হাতে করে নিয়ে বাসে ওঠেন। যাঁদের গাঁট বড় ও বেশি তাঁরা কুলি বা ভ্যানের সাহায্যে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নিয়ে ট্রাক, লরি ও পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যান। আবার অনেক ক্রেতা কাপড় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিজ এলাকায় পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে হাটের দিনগুলোতে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ শ ট্রাক কাপড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।

অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো বাবুরহাটের ছোট–বড় কাপড় ব্যবসায়ীরাও করোনার দুই বছরে ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন। অবশেষে ঈদ উপলক্ষে বেচাবিক্রি বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই ঈদেই সবচেয়ে বেশি কাপড় বেচাকেনা হয়। করোনার ধাক্কা সামলে ব্যবসা-বাণিজ্য জমে উঠতে শুরু করলেও পাইকারের সংখ্যা আগের তুলনায় কম। ফলে বেচাবিক্রির পরিমাণ এখনো করোনার আগের সময়ের চেয়ে কম। করোনার পরে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত বিক্রি কমেছে। এ ছাড়া সুতাকলের মালিকেরা সিন্ডিকেট করে সুতার দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেশি পড়েছে। এতে কাপড়ের দামও বেড়েছে। ফলে বিক্রি কমেছে।

হবিগঞ্জ থেকে আসা আলী হোসেন নামের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, ‘বাবুরহাটে পাইকারি দামে দেশীয় সব ধরনের কাপড় একসঙ্গে কেনা যায়। তাই পরিস্থিতি ভালো থাকলে সারা বছরই এখানে আসি। এ বছর কাপড়ের দাম তুলনামূলক বেশি।’

কুড়িগ্রামের ব্যবসায়ী রাকিব মিয়া বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির পর ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও বাজারে অন্য জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় লোকজন সেভাবে কাপড় কিনছেন না। তবে খুচরা বাজারে ঈদের বেচাকেনা পুরোদমে শুরু হয়েছে। শেষ মুহূর্তে বেচাকেনা বাড়বে—এই আশায় বাবুরহাটের কাপড় বেশি করে কিনে নিয়েছি।’

প্রিন্ট বা ছাপা শাড়ির পাইকারি বিক্রেতা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, এ বছর রোজার শুরু থেকেই সারা দেশের ক্রেতারা হাটে আসতে থাকায় মোটামুটি বিক্রি হয়েছে। তবে পাইকারি ক্রেতারা হাটে এলেও কাপড় কিনছেন পরিমাণে কম। সুতার দাম বাড়ার কারণে সব ধরনের কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। তবু এবারের বেচাকেনা করোনার খরা কাটাতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করেন।

থ্রিপিস বিক্রেতা অমিত সাহা বলেন, ‘প্রতিবছরই ঈদে নিত্যনতুন ডিজাইনের থ্রিপিস বাজারে আনি আমরা। এবারও প্রচুর নতুন ডিজাইনের থ্রিপিস তোলা হয়েছে। তবে বিক্রি আশানুরূপ না হলেও করোনা–পরবর্তী সময় বিবেচনায় বেচাবিক্রি মোটামুটি ভালো বলতে হবে।’

শেখেরচর-বাবুরহাট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এই ঈদের বেচাকেনায় ব্যবসায়ীরা খুশি। করোনার লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা করছেন তাঁরা। সাধারণত এই হাটে প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্র করে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার কাপড় বেচাকেনা হয়ে থাকে। এ বছরও এর কাছাকাছি পরিমাণ বিক্রি হবে বলে আমার ধারণা।’

মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া আরও জানান, ঈদের বেচাকেনা কেন্দ্র করে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হাটটির অলিগলিতে ৪৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এতে হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা আরও নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারছেন।

এদিকে বাবুরহাটের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চের দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় প্রশাসনের নির্দেশে এখানে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ব্যবসায়ীদের অনুরোধে রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদের সময়ে জেলা প্রশাসন অনলাইনে কাপড় বেচাকেনার সুযোগ করে দিলেও তা ছোট ব্যবসায়ীদের সেভাবে কাজে আসেনি। প্রথম ধাপে প্রায় এক বছর হাটে সরাসরি উপস্থিতিতে কেনাবেচা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ব্যবসায়ীরা হাটে এসে বেচাকেনা শুরু করেন। কিন্তু তখন ক্রেতা ছিল কম। চলতি বছরের শুরু থেকে বাবুরহাটে পুরোদমে বেচাকেনা চলছে।