রপ্তানিতে নগদ সহায়তার ব্যয় পাঁচ বছরে দ্বিগুণ

রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দিতে সরকারের ব্যয় প্রতিবছর বাড়ছে। বিগত অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা পাঁচ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

চলতি বছর এ ব্যয় আরও বাড়বে। কারণ অর্থ মন্ত্রণালয় এ বছর নতুন পাঁচটি পণ্যকে নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া চারটি পণ্যে সহায়তার হার বাড়ানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে যে পাঁচটি পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা মিলবে, সেগুলো হলো তথ্যপ্রযুক্তির পণ্য, কাপড়ের তৈরি জুতা, ওষুধের কাঁচামাল, ব্যাটারি ও নারকেলের ছোবড়ার আঁশ থেকে উৎপন্ন পণ্য। এ ছাড়া চলতি বছর হোগলা, খড়, আখের ছোবড়া ইত্যাদি দিয়ে তৈরি পণ্য ও চামড়া শিল্পনগর থেকে উৎপাদিত চামড়া রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ এবং আলু রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

রপ্তানি আয়ের বিপরীতে সরকার নগদে যে ভর্তুকি দেয় তা-ই নগদ সহায়তা। ১০ শতাংশ নগদ সহায়তার মানে হলো, ১০০ টাকা রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকেরা সরকারের কাছ থেকে ১০ টাকা পান। চলতি অর্থবছর ২৭টি পণ্য বা ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে, যা দুই বছর আগেও ১৪টিতে সীমাবদ্ধ ছিল।

বাজেট নথি থেকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণ করা উপাত্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে নগদ সহায়তা বাবদ সরকারের ব্যয় ছিল ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা হয়েছে। নগদ সহায়তার তালিকায় এমন কিছু খাত আছে, যারা দশকের পর দশক ধরে এ সুবিধা পাচ্ছে। আবার নগদ সহায়তার অর্থ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও বিস্তর। অনেক সময় ভুয়া নথি দাখিল করে এবং রপ্তানির টাকা দেশে না এনেও নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয় কোম্পানিগুলো।

এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নগদ সহায়তা দিয়ে রপ্তানি খাতকে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করা যায় না। এ জন্য দরকার রপ্তানিবান্ধব শুল্কনীতি ও অনুকূল বিনিময় হার। তিনি মনে করেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মতো সম্ভাবনাময় খাতে সাময়িক নগদ সহায়তা দেওয়া ঠিকই আছে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি খাতকে টেকসই করতে হলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, উচ্চ সুরক্ষার কারণে দেশের বাজারেই পণ্য বিক্রিতে লাভ বেশি। এতে শিল্প খাত রপ্তানিমুখী হচ্ছে না।

পিআরআইয়ের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রকৃত মূল্য ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে ৮ বছরে ইউরোর বিপরীতে টাকার মান বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। এতে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে গেছে বলে মনে করে পিআরআই। সংস্থাটির বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, দেশের পাদুকা খাত ২৭৩ শতাংশ, কৃষিভিত্তিক শিল্প ১৮৭ শতাংশ, সিরামিক ২১৫ শতাংশ ও প্লাস্টিক পণ্য ২৬০ শতাংশ সুরক্ষা (ইফেক্টিভ রেট অব প্রোটেকশন) পাচ্ছে। এতে দেশে এসব পণ্য আমদানিতে বেশি খরচ পড়ছে। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা মুনাফা বেশি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটা শিল্পকে রপ্তানিমুখী করতে নিরুৎসাহিত করছে।

নগদ সহায়তা পেয়ে অনেক সময় রপ্তানিকারকেরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করেন। ভারত বাংলাদেশের পাট পণ্য রপ্তানিতে যে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে, তার পেছনে এই নগদ সহায়তা দায়ী বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া কোনো দেশ পণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি দিলে আমদানিকারক দেশ বিপরীতে সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাউন্টারভেইলিং শুল্ক আরোপ করতে পারে।

অবশ্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বৈশ্বিক রপ্তানি প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে নগদ সহায়তা দিতে হয়। তিনি বলেন, এ দেশে উৎপাদন খরচ বেশি। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমানো যায় না। এ জন্য রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা দিতে হয়।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, নগদ সহায়তার যাতে অপব্যবহার না হয় এবং এর ব্যবস্থাপনা যেন ঠিক থাকে, তা নজরে রাখতে হবে। কখন বাড়াতে হবে, কখন কমাতে হবে, কখন বাদ দিতে হবে তা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এটি সরকারের একটি আর্থিক দায়ও।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে তা মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। নগদ সহায়তা পেয়েও অনেক খাতের রপ্তানি আয় কমে গেছে।