মালিকানা পরিবর্তনের পর লোকসানে কমার্স ব্যাংক

পরপর দুই বছর লোকসান করেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ২০১৬ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত এ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকে ব্যাংকটি মুনাফার ধারায় ছিল। যদিও মুনাফার পরিমাণ ছিল খুবই কম।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে এসে ২৩২ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে ৫২ কোটি টাকা লোকসান করেছে ব্যাংকটি। শিগগিরই লোকসানের এ ধারা থেকে বের হতে পারবে এমন সম্ভাবনাও কম। কারণ, যেসব বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, বিশেষ সুবিধার আওতায় ব্যাংকটি তা নিয়মিত করতে পারেনি। আবার ব্যাংকটি কার্যত কোনো ব্যবসার মধ্যেও নেই। তবে থেমে নেই জনবল নিয়োগ। ফলে খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না।

 কমার্স ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ব্যাংকটির আমানত ও ঋণ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালে আমানত ও ঋণ বেড়ে হয় যথাক্রমে ৩ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা ও ২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫০৩ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ৪৭ শতাংশ ঋণই খেলাপি। আবার ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা ৬৬৭ কোটি টাকার আমানতও ব্যাংকটি ফেরত পাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠান সুদও দিচ্ছে না।

জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) জাফর আলম বলেন, ‘২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে আগের সব পুঞ্জীভূত নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। গত বছরে বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ কারণে লোকসান হয়েছে। তবে আমরা কিছু ঋণ বিশেষ সুবিধায় পুনঃ তফসিল করেছি, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।’

ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকটির ৫১ শতাংশ মালিকানা সরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে থাকলেও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকটিতে নেই। নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে একটি শিল্পগ্রুপের হাতে। যার কারণে এমন পরিণতি হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে টেরাকোটা টাইলস রপ্তানির নামে টাকা পাচার করা এসবি গ্রুপ নিয়ে। গ্রুপটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১৯৮ কোটি টাকা। গ্রুপটি বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে ৮ কোটি টাকা এককালীন জমাও দিয়েছে। এরপর বড় খেলাপি আলোচিত নুর উন নবী ও সংশ্লিষ্টদের ১০৪ কোটি টাকা, প্রতিষ্ঠানটিও বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রয়েছে। এরপর বড় খেলাপি জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরীর যমুনা অ্যাগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ১১৪ কোটি টাকা। বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে শওকত চৌধুরী আবেদনও করেননি। তবে বিশেষ সুযোগে এফআর জুটের ৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত করেছে ব্যাংকটি। এ সুযোগে সব মিলিয়ে ৪০ প্রতিষ্ঠানের ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরও ৪০০ কোটি টাকা ঋণ।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘নতুন করে আর কোনো বড় ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। তাই এসএমই খাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে কমার্স ব্যাংক।’

ব্যাংক সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংকটি তারল্যসংকটে ভুগছে। চাহিদামত আমানত পাচ্ছে না, নেই ঋণ কার্যক্রমও। তবে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হচ্ছে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বছরে পরিচালকদের সম্মানী বাবদ খরচ হচ্ছে ৬০ লাখ টাকা। ভাড়া বাবদ খরচ হচ্ছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের পর আর্থিক অবস্থার অবনতি শুরু হলেও জনবল নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে।

কমার্স ব্যাংকের মালিকানার ৫১ শতাংশ রয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংক ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির ৪০ শতাংশ শেয়ার ছিল বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, এমজিএইচ ও আনোয়ার গ্রুপের হাতে। ২০১৬ সালের শুরুতে বেসরকারি সব শেয়ার কিনে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ।

 ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবলুপ্ত বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (বিসিআইএল) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। পরে তফসিলি ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়।