গত এক বছরে ফ্ল্যাট বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে

ফ্ল্যাট
ছবি: প্রথম আলো

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে আবাসন খাতের ব্যবসা–বাণিজ্যে গতি নেই। নতুন প্রকল্প ও প্রস্তুত (রেডি) ফ্ল্যাটের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ সংশোধন না হওয়ায় নয়া প্রকল্পের সংখ্যাও কমেছে।

একাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পরবর্তী ঘটনার প্রভাবে আবাসন ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসে। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়লেও বেচাবিক্রি আগের অবস্থায় ফেরেনি। এখনো ফ্ল্যাটের বেচাবিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকের কম। আগে বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাট কিংবা বাণিজ্যিক জায়গার কিস্তি পরিশোধও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এতে ছোট–মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দাম কমিয়েও ক্রেতা পাচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান।

দেশের অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। ধীরে ধীরে আবাসন ব্যবসা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। অন্যদিকে ঢাকার জমি উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগে থেকেই অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশছোঁয়া। তাতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের নিচের মানুষের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কেনাটা বেশ কঠিন। তারপরও এক হাজারের বেশি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। তার বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকায়। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে থাকে।

করোনার প্রথম ঢেউয়ে প্রথম দেড়–দুই মাস আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা প্রায় স্থবির হয়ে যায়। তারপর দ্রুতই আবার ঘুরে দাঁড়ায়। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলারের দাম বেড়ে যায়। তখন নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়ে। তখন অধিকাংশ কোম্পানিই অ্যাপার্টমেন্ট বা বাণিজ্যিক স্পেসের দাম বাড়ায়। ২০২২ সালের আগস্টে ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-২০৩৫ সাল) কার্যকর হয়। আগে মধ্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, এখন ড্যাপের কারণে ৬০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে জমির মালিকেরা আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্প করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা কমেছে। যদিও ড্যাপ সংশোধনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন রিহ্যাব নেতারা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ড্যাপ সংশোধন শেষ হচ্ছে না।

‘‘আবাসন খাতের ব্যবসায় মন্দা চলছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এক–দেড় বছর আগের চেয়ে ৪০–৫০ শতাংশে নেমেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও ব্যবসাবান্ধব নীতি না থাকার খেসারত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবাসন খাতের ব্যবসায় গতি না থাকায় রড, সিমেন্ট, ইট–বালু, সিরামিকসহ বিভিন্ন সংযোগশিল্পের ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে
মো. ওয়াহিদুজ্জামান সভাপতি, রিহ্যাব

গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে যায়। এমনকি অনেক গ্রাহক ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ নিয়মিত করছেন না। বেচাবিক্রিতে মন্দাভাবের প্রভাব পড়েছে সংযোগশিল্পেও। শীর্ষস্থানীয় একাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, গত এক বছরে ঢাকার অভিজাত এলাকার উচ্চমূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। মাঝারি দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি ৪০–৫০ শতাংশ কমেছে। তুলনামূলক কম দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেছে ২০–৩০ শতাংশ। তবে বাণিজ্যিক জায়গার বিক্রিও সামান্য কমেছে। আগে বিক্রি হওয়া উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাটের কিস্তি বেশি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

ঐশী প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান মো. আইয়ূব আলী প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন ব্যবসার অবস্থা ভালো না। অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে রেডি ফ্ল্যাট থাকলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। এমনকি দাম কমিয়েও বিক্রি করতে পারছে না কেউ কেউ। বর্তমানে বসুন্ধরায় ছয়টি ও মালিবাগে একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঐশী প্রপার্টিজ। তবে বেচাবিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেকের কম বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, শিগগিরই অবস্থার উন্নতি না হলে অনেক কোম্পানি টিকে থাকতে পারবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক দশকে সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও আইনজীবী, উচ্চপদস্থ করপোরেট কর্মকর্তারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরাই বেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্রেতার তালিকাও বদল হয়েছে। এখন যাঁরা ফ্ল্যাট কিনছেন, তাঁদের বড় অংশই চিকিৎসক। অন্য পেশার লোকজনও আছেন। তবে সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা কম।

৩০ বছর আগে ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করা ট্রপিক্যাল হোমস এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব প্রকল্পের ২ হাজার ৪০০ অ্যাপার্টমেন্ট গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ৫০ লাখ বর্গফুট বাণিজ্যিক জায়গা হস্তান্তর করেছে। জানতে চাইলে ট্রপিক্যাল হোমসের পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) এম হক ফয়সাল বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় গতি কম। কমার্শিয়ালের বিক্রি কমেছে সামান্য। নতুন ড্যাপের জন্য নতুন আবাসন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজউকে প্রকল্প পাসের গতিও শ্লথ। তারপরও চলতি বছর ট্রপিক্যাল হোমস ১৫টি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানালেন তিনি।

ড্যাপের কারণে ঢাকার অনেক এলাকায় জমি পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। কারণ, ভবনের উচ্চতা আগের চেয়ে কম পাওয়া যায়। ফলে যে জমি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যেমন আগে কলাবাগানে ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতিবর্গফুট ১২–১৩ হাজার। এখন কিনতে গেলে লাগবে ১৭–১৮ হাজার টাকা। এমন তথ্য দিয়েছেন ক্রিডেন্স হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিল্লুল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফ্ল্যাটের বিক্রি কমে যায়। অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ বিনিয়োগ করতে চায় না। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা থেকেই মূলত ফ্ল্যাট কেনে। তবে আশার কথা হচ্ছে, দুই–তিন মাস ধরে ক্রেতাদের খোঁজখবর নেওয়ার হার কিছুটা বেড়েছে।