আইএমএফের কাছে না গেলে বড় বিপর্যয় হতে পারত

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। বাংলাদেশ সময়মতো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণের জন্য গেছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। ভারতের এই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, সময়মতো আইএমএফের কাছে না গেলে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারত। শ্রীলঙ্কা তা পারেনি, সে জন্য তারা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে শুক্রবার ‘বাঙলার পাঠশালা’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন কৌশিক বসু। উন্নয়ন নীতি নিয়ে ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।

কৌশিক বসু মনে করেন, বাংলাদেশের পক্ষেও ভালোভাবে সংস্কার করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে সাধারণ মানুষের জন্য আপৎকালীন কিছু করতে হবে। তাহলে তারা মনে করবে, সরকার তাদের জন্য কিছু করছে। অর্থাৎ ভারসাম্য রাখতে হবে।

সাংবাদিকেরা কৌশিক বসুর কাছে নানান বিষয়ে মতামত জানতে চান, যার মধ্যে একটি ছিল আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ ও ঋণের শর্ত প্রসঙ্গ। আইএমএফের শর্তের কারণে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হয়। এতে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এ প্রসঙ্গে কৌশিক বসু বলেন, সারা জীবন এই ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। আবার সাধারণ মানুষ সবচেয়ে অরক্ষিত, তাদের কথা ভাবতে হবে, সংস্কারও করতে হবে।

আইএমএফের শর্তের প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালে ভারতের একটি ঘটনা তুলে ধরেন কৌশিক বসু। তিনি বলেন, তখন ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ দিয়ে ১৩ দিনের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো অবস্থা ছিল। সেই অবস্থায় ভারত আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। তারা সহায়তা করল। তবে ভারত তখন খুব ভালোভাবে সংস্কার করেছে। দুই বছর পর ভারত আইএমএফকে বলল, বাকি অর্থের প্রয়োজন নেই।

আতিউর রহমান কৌশিক বসুকে বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। এরপর কৌশিক বসু যখন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ, তখন তাঁর চেষ্টায় সেই বরফ গলে।

কৌশিক বসু মনে করেন, বাংলাদেশের পক্ষেও ভালোভাবে সংস্কার করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে সাধারণ মানুষের জন্য আপৎকালীন কিছু করতে হবে। তাহলে তারা মনে করবে, সরকার তাদের জন্য কিছু করছে। অর্থাৎ ভারসাম্য রাখতে হবে। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির বিপরীতে কর আদায়ের অনুপাত) ১৪-১৫ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন, যা এখন ১০ শতাংশের নিচে।

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান মূল অনুষ্ঠানে কৌশিক বসুকে নিয়ে বলেন, তিনি (কৌশিক বসু) এক কঠিন কাজ করেছেন। তিনি মূলত বিদ্যায়তনের মানুষ। সেখান থেকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আহ্বানে দেশটির প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন। অর্থাৎ গবেষণা ও লেখালেখির জগৎ থেকে তিনি নীতি প্রণয়নের জগতে গেছেন। আবার সেখান থেকে বিদ্যায়তনে ফিরে এসেছেন, যদিও অনেকে তা পারেন না।

বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আহমেদ জাভেদ আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, গবেষক ও নীতিপ্রণেতাদের সম্পর্ক কেমন, সে বিষয়ে আলোকপাত করতেই এ অনুষ্ঠান। গবেষক বা পরামর্শকদের কোনো পরামর্শ নীতিপ্রণেতারা গ্রহণ করেন, আবার কোনোটা গ্রহণ করেন না। কোনো পরামর্শ ঠিক কী কারণে গৃহীত হয়, আর কোনো পরামর্শ কী কারণে গৃহীত হয় না, এর বিজ্ঞানটা কী, সে বিষয়ে কথা বলবেন বক্তারা।

এ প্রসঙ্গে কৌশিক বসু বলেন, গবেষণা ও নীতি প্রণয়নের মধ্যে সম্পর্ক আছে। অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, চিন্তারও শক্তি আছে। আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করে সেই উপলব্ধি হয় তাঁর। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একবার ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেল। তখন সরকার মজুত খাদ্য বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আগের নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য পাঁচজন পরিবেশককে দেওয়া হবে। তখন নিজের পাঠের আলোকে তিনি পরামর্শ দেন, পাঁচজনকে না দিয়ে ৫০ জনকে দেওয়া হোক; তাহলে সিন্ডিকেট (বাজার নিয়ন্ত্রণে অসাধু জোট) হবে না। মনমোহন সিং তাৎক্ষণিকভাবে তা মেনে নেন।

কৌশিক বসু বলেন, তাঁর সব পরামর্শ সরকার নেয়নি। সে জন্য নীতি নির্ধারণের জায়গায় টিকে থাকতে হলে কিছু কিছু বিষয় এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হবে বলে তিনি মত দেন। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক শক্তির জন্য মানুষের আস্থা অর্জন খুবই প্রয়োজন। নাম উল্লেখ না করে একটি দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হঠাৎ কমে গিয়েছিল। কিন্তু কমার কোনো কারণই ছিল না। পরে দেখা গেল যে সেখানে রাজনৈতিক শক্তির প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।

আমলারা যাতে কথা শোনেন, সে জন্য নিজের কৌশলের কথাও তুলে ধরেন কৌশিক বসু। তিনি বলেন, দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক স্কুল খোলার চেষ্টা করে সাড়া পাচ্ছিলেন না। তখন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। আমলারা তাঁকে অভ্যর্থনাকক্ষে দেখে জানতে চান, তিনি কেন এসেছেন। এরপর জাদুর মতো কাজ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমলারা ফোন ধরা শুরু করেন, চিঠির উত্তর দেন।

অনুষ্ঠানে রসিকতাও করেন কৌশিক বসু। তিনি বলেন, ‘আমি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় কলাম লিখতাম। অবাক বিষয়, এই খটমট অর্থনীতির কলাম আমাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলল। এতই জনপ্রিয় হলো যে দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন।’ তিনি বলেন, ‘বহুদিন আমি বুঝিনি, এই অর্থনীতির কলাম এত কে পড়ে। হুট করে একদিন আবিষ্কার করলাম, ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রীতি জিনতাও একই পত্রিকায় একখানা কলাম লেখেন লাইফস্টাইল (জীবনযাপন) নিয়ে। ওটা ছাপা হয় ঠিক আমার কলামের পাশে। লোকে ওটা খুঁজতে গিয়ে ভুল করে আমারটাও পড়ে ফেলে।’

আরও পড়ুন

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি নিজের বক্তব্যের একটি পর্যায়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা আরও বাড়ানো দরকার।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ এস আর ওসমানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুমানা হক, সায়েমা হক প্রমুখ।

আরও পড়ুন

আতিউর রহমান কৌশিক বসুকে বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। এরপর কৌশিক বসু যখন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ, তখন তাঁর চেষ্টায় সেই বরফ গলে।

আরও পড়ুন