মৌসুমের শুরুতে রডের দাম বাড়তি 

রডের কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তা ছাড়া জ্বালানিসংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। 

এক বছরের বেশি সময় ধরে রডের দাম কখনো বাড়ছে, কখনোবা কমছে। গত আগস্টে এই নির্মাণসামগ্রীর দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে। দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৯৩ হাজার টাকা। তারপরে দাম আরও বাড়ে। মাঝে কিছুটা কমলেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে রডের দাম আবার বাড়ল টনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। এমন সময়ে রডের দাম বেড়েছে, যখন নির্মাণকাজের ভরা মৌসুম। 

ইস্পাত খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী বললেন, রডের মূল্যবৃদ্ধির বড় দুটি কারণ হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের বেশি কেউ ব্যবহার করতে পারছে না কোনো কোম্পানি। এতে করে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি। বর্তমানে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্রও খোলা যাচ্ছে না। তাতে সামনের দিনে ইস্পাতশিল্পে সংকট আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা তাঁদের।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রডের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ১২ শতাংশের মতো। ঢাকায় গতকাল প্রতি টন রড ৮৫ হাজার ৫০০ থেকে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহে এই রডের দাম ছিল ৮৫ হাজার ৫০০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। সাধারণত কোম্পানি ও এলাকাভেদে রডের দাম ভিন্ন হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন গত রাতে বলেন, ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। দেশের বাজারেও প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ৫১ হাজার থেকে বেড়ে ৬৩ হাজার টাকা হয়ে গেছে। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে প্রতি টন পণ্য উৎপাদনে সময়ও বেশি লাগছে। সব মিলিয়েই রড উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। 

টঙ্গীতে নিজেদের কারখানার উৎপাদন পরিস্থিতি তুলে ধরে মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের কারখানায় ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎসংযোগ আছে। তবে আমরা সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। দিনে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। গ্যাসের সংকট তো আছেই। এতে রড উৎপাদনে গড় সময় ও খরচ বেড়েছে।’ 

বর্তমানে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানি ভালোই হয়েছে। এই সময়ে পুরোনো লোহার টুকরো আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৫ লাখ চার হাজার টন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় লোহার টুকরো আমদানি ১৫ শতাংশ বেড়েছে। 

রড তৈরির আরেক কাঁচামালের উৎস পুরোনো জাহাজের আমদানি কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম চার মাসে পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন ওজনের। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬ লাখ ৩১ হাজার টনের পুরোনো জাহাজ। পুরোনো জাহাজের আমদানি অর্ধেকের মতো কমেছে। 

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএমআর মেটালার্জিক্যাল রিসোর্সেস কোম্পানি বাংলাদেশের ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে পুরোনো লোহার টুকরোর দাম কিছুটা কমেছে। তবে এখন পুরোনো লোহার টুকরার আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও ঋণপত্র খোলার হার কম। তাতে সামনে কাঁচামাল আমদানি কমে যেতে পারে।

ইস্পাত খাতের মাঝারি ও শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, রড উৎপাদনের কাঁচামালের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাকিটা দেশীয় উৎস থেকে মেটানো হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছোট-বড় সব কোম্পানিই ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছে। দ্রুত এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শুষ্ক মৌসুমের শেষের দিকে কাঁচামালের সংকটে পড়তে পারে অনেক কারখানা।

দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আবার ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ার কারণেও খরচ বেড়েছে। 

গাজীপুরে মেট্রোসেম ইস্পাতের কারখানায় দিনে ৫০০ টন রড উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে ২০০ টনের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তার কারণ, শীত এলেও দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। সপ্তাহে এক দিন কারখানা বন্ধ। গ্যাসের চাপ কম। সব মিলিয়ে রডের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে তারা প্রতি টন রড ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি করলেও এখন তা ৮৮ হাজার টাকা। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে মেট্রোসেম ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো কাঁচামালের ঋণপত্র খুলতে নিরুৎসাহিত করছে। তাতে সামনের মাসগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। রড উৎপাদনে বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসেরও প্রয়োজন হয়। শীত মৌসুম শুরু হওয়ায় বিদ্যুতের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও গ্যাসসংকটের সমাধান হয়নি। তাতে উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পাইপলাইনে কাঁচামালের জোগানও পর্যাপ্ত নেই। তাই দাম বেড়েছে।