এক মাসে একটি ডিমও এল না কেন

১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। কেউ আমদানি করেনি এখনো।

ডিম
ফাইল ছবি: এএফপি

বাজারে দামে লাগাম টানতে এক মাস আগে যে ডিম আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা এখনো আসেনি। ফলে দাম তো কমেইনি, উল্টো বেড়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। পরে পর্যায়ক্রমে মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।

আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে, শিগগিরই ডিম আসবে। তবে আসেনি। ডিম আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠান মীম এন্টারপ্রাইজের মালিক ইয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ডিম আমদানি করবেন ভারত থেকে। সেখানে আমদানির শর্তপূরণসংক্রান্ত নথিপত্র পেতে দেরি হচ্ছে। আরও কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই এখনো ডিম আমদানি করা যায়নি।

ইয়ার হোসেন আরও বলেন, ডিম আমদানিতে শুল্ক–করের হার ধরা হয়েছে ৩৩ শতাংশের মতো। এত শুল্ক–কর দিয়ে ডিম এনে মূলধন টেকানো যাবে কি না, সেটি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসায়িক স্বার্থ আগে। লাভ হলেই কেবল তাঁরা আমদানি করবেন। ভোক্তার সুবিধার কথা চিন্তা করলে সরকারকে ডিম আমদানি করতে হবে।
গোলাম রহমান, সাবেক বাণিজ্যসচিব ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি
ডিম
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাজারে সাধারণত ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দাম প্রতি ডজন (১২টি) ৯০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে থাকত। গত বছরের আগস্ট থেকে ডিমের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ডজন ১৫০ টাকায় ওঠে। এরপর দাম কিছুটা ওঠা–নামা করেছে। কিন্তু আগের জায়গায় ফেরেনি।

গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বৈঠক করে ডিম প্রতিটি ১২ টাকা, আলু প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা বেঁধে দেয়।

আরও পড়ুন

সরকার যখন ডিম আমদানির অনুমতি দেয়, তখন দেশের বাজারে ডিমের ডজন ছিল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। আশা করা হয়েছিল, আমদানি করা ডিম এলে বাজারে দাম কমবে; কিন্তু বেড়েছে। এখন বড় বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা এবং পাড়ার খুচরা দোকানে ১৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়।

ব্যবসায়ীরা যে হিসাব দিচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, আমদানি করা ডিমের দাম কম পড়ছে না। এতে বাজারে খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম; বরং সরকারের রাজস্ব আয় বেশি হবে।

ঘোষণার পর অনুমতিতে দেরি

ঘোষণা দিলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিম আমদানির আগ্রহ ছিল কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কারণ, আমদানির অনুমতিপত্র বা আইপি দেওয়া হয়েছে ঘোষণার ২০ দিনের মাথায় গিয়ে। আইপি দেয় আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, যেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও দপ্তরটির সূত্র বলছে, ডিম আমদানির শুল্ক–করের হার কী হবে, কোন এইচএস কোডের (বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য শনাক্তের নম্বর) অধীন ডিম আসবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। প্রশ্ন উঠেছে, একটি এইচএস কোড ঠিক করতে এত দিন লাগল কেন? তাহলে কি ডিম আমদানি অগ্রাধিকারে ছিল না।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শতে৴ একজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর এইচএস কোড ঠিক করে আইপি দিতে এক দিনের বেশি লাগার কোনো কারণ নেই। সেখানে লেগেছে ১৮ দিন।

ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসায়িক স্বার্থ আগে। লাভ হলেই কেবল তাঁরা আমদানি করবেন। ভোক্তার সুবিধার কথা চিন্তা করলে সরকারকে ডিম আমদানি করতে হবে।
সাবেক বাণিজ্যসচিব ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান

শুল্ক–কর ও শর্ত

ডিম আমদানিতে যে এইচএস কোডটি ঠিক করা হয়েছে, সেটিতে শুল্ক–করের হার ৩৩ শতাংশ। মানে হলো, ১০০ টাকার পণ্য আমদানিতে ৩৩ টাকা রাজস্ব আয় হবে সরকারের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের বাজারে ডিমের যে দর, তাতে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিটিতে দুই টাকার মতো রাজস্ব পাবে সরকার।

টাইগার ট্রেডিংয়ের মালিক সাইফুর রহমান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিটি ডিমের দাম সোয়া ১০ থেকে সাড়ে ১০ টাকা পড়তে পারে। এরপর আমদানিকারক ও খুচরা পর্যায়ের মুনাফার প্রশ্ন। তিনি জানান, তাঁরা একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকার মোড়ে মোড়ে ডিম বিক্রির পরিকল্পনা করছেন।

ব্যবসায়ীরা যে হিসাব দিচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, আমদানি করা ডিমের দাম কম পড়ছে না। এতে বাজারে খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম; বরং সরকারের রাজস্ব আয় বেশি হবে।

ডিম আমদানিতে শর্তপূরণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ডফ্লুমুক্ত দেশ থেকে ডিম আমদানি করার কথা বলা হয়েছিল। আমদানিকারকেরা বলছেন, সেই সনদ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

একটি কোম্পানি গত সপ্তাহে বলেছিল, তারা যে ডিম আমদানি করবে, তা ভারতে মোড়কজাত করা হচ্ছে; কিন্তু তাঁদের ডিম আসেনি। সূত্র বলছে, নানারকম শর্তপূরণ ও কর দিয়ে ডিম আমদানি করে লাভের মুখ দেখার আশা কম। তাই তারা আমদানিতে ঢিলেমি শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

ছুটি নিয়ে দুশ্চিন্তা

এদিকে দুর্গাপূজার ছুটি নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, পূজা ঘনিয়ে আসছে। ছুটি শুরু হলে স্থলবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কলকাতার ব্যবসায়ীরাও উৎসবে ব্যস্ত থাকবেন।

সব মিলিয়ে এক মাস আগে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। আলু ও পেঁয়াজের বেঁধে দেওয়া দাম মানেননি ব্যবসায়ীরা। এখন ডিম আমদানিতেও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।

সাবেক বাণিজ্যসচিব ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসায়িক স্বার্থ আগে। লাভ হলেই কেবল তাঁরা আমদানি করবেন। ভোক্তার সুবিধার কথা চিন্তা করলে সরকারকে ডিম আমদানি করতে হবে।