চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ব্যাংকিং পেশায় নারীর অংশগ্রহণ স্থবির হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণ আছে বলেই মনে হয়। দেশে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়েনি। ব্যাংকিং পেশায় আসার জন্য যে ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এটা তাঁদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

নারীদের ব্যাংকের কাজে অংশগ্রহণের হার স্থবির হয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে সামাজিক। নারীরা সাধারণত শিক্ষকতা করবে বা সহজ-সরল ধরনের কাজ করবে, এমন মানসিকতা সমাজে আছে। নারীরা টাকাপয়সা নিয়ে বা উচ্চ দক্ষতা প্রয়োজন হয় এমন পেশায় কাজ করবে, সে বিষয়ে সমাজে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব আছে।

এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে দেশের শহরাঞ্চলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। আমার ধারণা, এই পরিসংখ্যান মূলত নিম্ন দক্ষতার কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোভিডের সময় যাঁরা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো আর শহরে ফেরেননি, গ্রামেই কিছু না কিছু করছেন, সে কারণে শহরাঞ্চলের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে বলে ধারণা করা যায়। যদিও সামগ্রিকভাবে নারীদের কাজের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আছে বলেই বোধ করি।

আরেকটি বিষয় হলো সংবেদনশীলতা। নারীদের কাজের জন্য যে ধরনের পরিবেশ বা সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তা অনেক জায়গাতেই নেই। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে নারীদের কাজ করা অনেকটা কঠিন বলেই আমরা জানি, সেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের ওপর কিছু দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকিং পেশার মতো ডিমান্ডিং কাজ করা তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক সময় তাঁরা পারিবারিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হন। সে জন্য আমি মনে করি, পারিবারিক দায়িত্ব ভাগাভাগি করা হলে নারীর পক্ষে চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসার সুযোগ বাড়বে।

আরও পড়ুন

তা না থাকায় দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। একদম পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারব না, তবে বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নারীরা ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংককে অগ্রাধিকার দেন। সরকারি ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় তুলনামূলক কম সময় দিতে হয় বা কাজের ক্ষেত্রে কিছু নমনীয়তা থাকে। সরকারি চাকরিতে সামগ্রিকভাবে যে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, তার পেছনেও সম্ভবত এটি মূল কারণ।

নিয়োগকর্তাদের মধ্যেও নারীদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মানসিকতা কাজ করে। স্বীকার করি, অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময় কাজ করার প্রয়োজনীয়তা থাকে, বাণিজ্যিক কারণেই তা থাকে। বাস্তবতা হলো সামাজিক, পারিবারিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের পক্ষে দীর্ঘ সময় কাজ করা কঠিন। সে জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা রাতের বেলায় নারীদের ফেরার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা—এসব ব্যবস্থা থাকা উচিত। সেটা যেমন গণপরিবহন হতে পারে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকও হতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বেসরকারি খাতে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে নারীর মোটামুটি অংশগ্রহণ থাকলেও উচ্চ পদে একেবারেই কম, বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংক ও খাতে এই প্রবণতা দৃশ্যমান। সরকারি চাকরিতে ইদানীং উচ্চ পদে নারীর অংশগ্রহণ দেখা গেলেও কিছুদিন আগেও তা এতটা ছিল না। উচ্চ পদে কাজ করতে হলে নারীদের কিছুটা স্বস্তি দিতে হবে। নারীদের উচ্চ পদে কাজ করার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে পারিবারিক চিন্তা, সে জন্য জেন্ডারবিষয়ক সংবেদনশীলতা প্রয়োজন।

বাস্তবতা হলো, নানা ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক চাপে নারীরা আনুষ্ঠানিক পেশা থেকে ছিটকে গিয়ে বা সেখানে প্রবেশ না করে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এটা একদিক থেকে ভালো, এই অর্থে যে নারীদের সুযোগ বাড়ছে, আগে যা একেবারেই সীমিত ছিল। কিন্তু আমি বলব, আনুষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা উচিত।

সরকার প্রতিবছর জেন্ডার বাজেট দেয়। বেসরকারি খাত যেন নারীদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সরকার বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। প্রণোদনার শর্ত হিসেবে বলা যেতে পারে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, ন্যূনতম মজুরি বা বেতন নিশ্চিত করা, শিশু দিবাযত্ন তৈরি ইত্যাদি।

সায়েমা হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।