দেশে দুই কোটির ওপর বাড়ির মালিক রয়েছেন। তাঁদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। তারপরও দেশে কর দিচ্ছেন মাত্র ২১ দশমিক ২৪ লাখ মানুষ। এই বাড়ির মালিকদের একবার ধরেন না, তাহলে তো চাপটা কমে। 
মো. জসিম উদ্দিন, সভাপতি, এফবিসিসিআই 

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটছে। ব্যাংক খাতে কীভাবে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব?

জসিম উদ্দিন: আমি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। সেই হিসেবে আমি ব্যাংকার। তবে আমার বড় পরিচয়, আমি একজন ব্যবসায়ী। ছোট থেকে বড় হয়েছি। ব্যাংক সাহায্য করলে ছোট ব্যবসায়ীও বড় হতে পারে। আমাদের দেশে দুটি সমস্যা। এক. একবার বিপদে পড়লে বের হওয়ার পথ থাকে না। ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো। দুই. বিপদে পড়লে কেউ কেউ বের হতে চান না। এখন আমাদের উচিত, কারা প্রকৃত আর কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, সেটি খুঁজে বের করা। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির নাটক বন্ধ করা দরকার। দেশের চেয়ে ব্যক্তি বড় হতে পারে না। এখন ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে বাংলাদেশ। আমাদের কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আগে এসব দেখতে চাইবে। আমাদের এখন ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কেন অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না?

জসিম উদ্দিন: বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত তাদের কাছে রয়েছে। যদি তথ্য-উপাত্ত থাকে, তাহলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে চলে যাওয়া উচিত। পাচারকারীদের তথ্য-উপাত্ত থাকলে শাস্তি দিতে অসুবিধা কোথায়? ৩ জনকে শাস্তি দিলে বাকি ১০ জন সোজা হয়ে যাবে।

এক বছর ধরে ডলার-সংকটে ভুগছে দেশ। তাতে কাঁচামাল কিংবা পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এই সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

জসিম উদ্দিন: আমাদের ডলার খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পে ৫০ বিলিয়ন ডলার আছে। সেসব প্রকল্প যদি দ্রুত করা যায়, তাহলে ডলার আসবে। তা ছাড়া অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। রোজার খেজুরে ইতিমধ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আমদানি হয়ে গেছে। আমাদের ঠিক করতে হবে, খেজুর আনব নাকি সয়াবিন তেল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল ও শিল্পের কাঁচামাল আনতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা ছাড়া আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যক্রম নিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেক অভিযোগ। আপনিও বিভিন্ন সময় এনবিআরের সংস্কারের কথা বলেছেন। সংস্কার কেন হচ্ছে না?

জসিম উদ্দিন: ৫০ বছর আগের এনবিআর দিয়ে এখন আর চলবে না। আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে রয়েছি। তাই এখন স্মার্ট এনবিআর দরকার। নতুন ভবনে যাওয়া মানেই কিন্তু স্মার্ট এনবিআর নয়। ডিজিটালাইজেশনে যেতে হবে। অ্যানালগ ব্যবস্থা বাদ দিতে হবে। তা না হলে পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন হবে না। কারণ, কিছু লোক আছে যারা কিনা এটিকে ব্যর্থ করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। আরেকটা বিষয় হলো এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। নীতি প্রণয়ন আর বাস্তবায়নকে আলাদা করতে হবে। ২০০৮ সালে এমন একটি এসআরও হয়েছিল। একটা গ্রুপ সেটিকে কার্যকর হতে দেয়নি। সুতরাং এখানে আরও কাজ করতে হবে। এনবিআরের প্রধান কাজ রাজস্ব আহরণ। শিল্পায়নের জন্যও তাদের কাজ করতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগও লাগবে। তার মানে এই নয় যে সামনে যাঁকে পাবেন, তাঁকেই চুষে খাবেন। দেশে দুই কোটির ওপর বাড়ির মালিক রয়েছেন। তাঁদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। তারপরও দেশে কর দিচ্ছেন মাত্র ২১ দশমিক ২৪ লাখ মানুষ। এই বাড়ির মালিকদের একবার ধরেন না, তাহলে তো চাপটা কমে। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের করদাতারা তো ৫০ শতাংশ কর দিচ্ছেন। তাঁদের কেন ডিস্টার্ব করছেন। তাঁদের সহায়তা করেন। কর আদায়ের জন্য নতুন নতুন জায়গায় যান। সহজে কর আদায়ের পথে হাঁটলে আর চলবে না।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আপনাদের প্রত্যাশা কী?

জসিম উদ্দিন: স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলার। তার পরের ১৪ বছরে তা বেড়ে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা চাই। আগের মতো হরতাল বা জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, সামনের দিনের রাজনীতি হতে হবে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। ক্ষমতা পরিবর্তিত হবে ভোটের মাধ্যমে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চায়। নীতিসহায়তা চায়। আগামী দিনে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেখানে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জসিম উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।