করোনার টিকায় অগ্রাধিকার ও সুশাসনের প্রতিফলন

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

১.

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেই বেশি সক্রিয় পাওয়া যায়। গান কিংবা আঁকা ছবি ফেসবুকে দেওয়া ছাড়াও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ছোট ছোট মন্তব্য করেন। যেমন গত ৩ ডিসেম্বর তিনি লিখেছিলেন, করোনার টিকার সঙ্গে সুশাসনের সম্পর্ক নিয়ে। মন্তব্যটি ছিল এ রকম—

করোনার ভ্যাকসিন ও উন্নয়ন ও সুশাসনের একটি ভিন্নধর্মী সূচক

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। তবে ভ্যাকসিনের লভ্যতা (দাম ও সরবরাহ) ও সংরক্ষণব্যবস্থার বিবেচনায় প্রথম ধাপে কেবল সীমিতসংখ্যক মানুষকেই এই টিকা দেওয়া সম্ভব হবে এবং পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা যাবে। সে জন্য কারা আগে টিকা পাবে, তার একটা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সদ্য একটি গাইডলাইন ঘোষণা করেছে, যাতে প্রত্যাশিতভাবেই স্বাস্থ্যকর্মী (তাঁদের মধ্যে আবার যেসব ডাক্তার ও নার্স সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন, আগে তাঁরা) এবং নার্সিং হোমে থাকা বয়োবৃদ্ধরা তালিকার প্রথমে আছেন। যুক্তরাজ্যের গাইডলাইনও একই রকম। বাংলাদেশেও এ ধরনের আগ্রাধিকারের গাইডলাইন তৈরির কাজ চলছে বলে শোনা যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও একটি গাইডলাইন হয়তো পাওয়া যাবে এবং অনুমান করা যায় সেটি উন্নত দেশগুলোর আগ্রাধিকারের গাইডলাইনের আদলেই হবে। এ ধরনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি মানদণ্ড থেকে বিভিন্ন দেশের গাইডলাইনের বিচ্যুতির মাত্রা কতখানি (এবং আরও ভালো হয় সেই গাইডলাইন বাস্তবে কতখানি পালিত হচ্ছে, অর্থাৎ অনিয়মের মাত্রা কী পরিমাণ, তার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা গেলে), তার ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক সূচক তৈরি করা যেতে পারে। এটিকে তাহলে সুশাসন ও উন্নয়নের মাত্রা এই দুটোরই একটি ভিন্নধর্মী বাড়তি সূচক হিসেবে কাজে লাগানো যাবে।

একটি দেশের শাসনব্যবস্থা কতখানি মানবিক গুণে সমৃদ্ধ তাও এ থেকে বোঝা যাবে; যেমন ঝুঁকির মুখে থাকা স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের সুরক্ষা, বয়োবৃদ্ধদের সুরক্ষায় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতা ও পদ বিবেচনা না করে শুধু করোনার ঝুঁকির বিবেচনায় অগ্রাধিকার নির্ণয় বা করোনার টিকাদানের মতো জরুরি জনস্বাস্থ্যসেবাকে শুধু বাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে না দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য খাতের যথাযথ দায়িত্ব পালন।
এটি মানুষের বাঁচা-মারার বিষয়; এবং সে কারণেই এ ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি সুশাসনের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা উন্নয়ন-অনুন্নয়নের লক্ষণ বুঝতে গেলে প্রকটভাবে ধরা পড়বে।

২.

এরপর এক মাসের বেশি সময় চলে গেছে। করোনার টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির ধরন নিয়েও অনেক আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাসের টিকা আমদানিতে ৪ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিল সরকার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই বরাদ্দসংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন পায়।

এই সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারে আছেন সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মী, বন্দরের কর্মী, ব্যাংকের কর্মী এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মী। এই তালিকায় আরও রয়েছেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, শ্রমঘন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক, শ্রমঘন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক, এতিমখানা, পরিবহনশ্রমিক বিদেশগামী ও বিদেশফেরত সব ব্যক্তি।

৩.

এ রকম এক প্রেক্ষাপটে করোনার টিকাদানের সঙ্গে সুশাসনের সম্পর্ক নিয়ে আজ বুধবার ফেসবুকে আরেকটু বিস্তারিত লিখলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি লিখেছেন—

করোনার টিকাদানের অগ্রাধিকার ও সুশাসনের প্রতিফলন

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্টে বলেছিলাম, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। তবে ভ্যাকসিনের লভ্যতা (দাম সরবরাহ ও সংরক্ষণব্যবস্থা) এবং টিকাদান কর্মসূচির সক্ষমতার বিবেচনায় প্রথম ধাপে কেবল সীমিতসংখ্যক মানুষকেই এই টিকা দেওয়া সম্ভব হবে এবং পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা যাবে। সে জন্য কারা আগে টিকা পাবে, তার একটা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যে গাইডলাইন অনুযায়ী তাদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে, তাতে প্রত্যাশিতভাবেই অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছেন স্বাস্থ্যকর্মী (তাঁদের মধ্যে আবার যেসব ডাক্তার ও নার্স সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাঁরা প্রথমে আছেন); এর সঙ্গে নার্সিং হোমে থাকা বয়োবৃদ্ধরাও আছেন। এরপর আছেন ৭৫-এর বেশি বয়সের মানুষ এবং জনগণের সংস্পর্শে আসা (যেমন ফুড মার্কেটের কর্মচারী) এবং জরুরি সেবাদানে নিয়োজিত যাঁরা (যেমন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি)। তারপরের ধাপে আছেন ৬৫ থেকে ৭৫ বয়সের মানুষেরা এবং এর কম বয়সের যাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, সেই সঙ্গে জরুরি আরও কিছু কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। জনসংখ্যার অন্য সবাইকে পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। যুক্তরাজ্যের গাইডলাইনও প্রায় একই রকম।

আমাদের প্রতিবেশী ভারতে আপাতত প্রথম পর্যায়ের জন্য তিনটি অগ্রাধিকার গ্রুপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে: প্রথম, ঝুঁকিতে থাকা সব স্বাস্থ্যকর্মী; দ্বিতীয়, পুলিশসহ জরুরি সরকারি সেবাদানে নিয়োজিতরা; তৃতীয়, পঞ্চাশের ঊর্ধ্বের জনগোষ্ঠী এবং এর থেকে কম বয়সের যাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন।

বাংলাদেশেও এ ধরনের আগ্রাধিকারের গাইডলাইন তৈরি হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর কিছুটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে বলে মনে হচ্ছে। বয়োবৃদ্ধদের কোনো উল্লেখই নেই, যেখানে অন্য দেশগুলোতে তাঁরা সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া শ্রেণিগুলোর অন্যতম। আমাদের তালিকার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রত্যাশিতভাবেই অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষেই আছেন, তবে জনপ্রতিনিধিরা ও ঢালাওভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তালিকার ওপরের দিকেই আছেন।

এ ছাড়া অন্য দেশগুলোতে রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের সুনির্দিষ্ট মতামতের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকার ঠিক করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটির বিষয়ে তেমন জানা যাচ্ছে না। নীতিমালার অগ্রাধিকার নির্ধারণের বিষয়ে অমর্ত্য সেন অর্থনীতির সামাজিক পছন্দক্রম বাছাই তত্ত্বের (সোশ্যাল চয়েজ থিওরি) একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন: যাঁদের পছন্দের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার নির্ণয় করা হচ্ছে, তাঁরা কি ব্যক্তিস্বার্থের বিবেচনায় মতামত দিচ্ছেন, নাকি তিনি সমাজের যে কেউ হতে পারতেন তা মনে করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মূল্যবোধের অবস্থান থেকে তা করছেন।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন

এ কথা ঠিক যে আর্থসামাজিক পরিবেশ এবং সংক্রমণের গতি-প্রকৃতির বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের অগ্রাধিকার এক রকম না হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে। এ ছাড়া গাইডলাইন যা-ই থাকুক, তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনিয়মের মাত্রা কতটুকু, সেটাও জরুরি বিষয়। টিকার ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

তবে সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, এই টিকাদান কর্মসূচির অগ্রাধিকার নির্ণয় ও বাস্তবায়নের মাপকাঠিতে একটি দেশের শাসনব্যবস্থা কতখানি মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, তা অনেকখানি বোঝা যাবে। বিষয়গুলোর মধ্যে আছে: জনস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব, স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের সুরক্ষা, বয়োবৃদ্ধদের সুরক্ষায় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিকদের সমানাধিকার, ক্ষমতা ও পদ বিবেচনা না করে শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিবেচনায় অগ্রাধিকার নির্ণয় বা করোনার টিকাদানের মতো জরুরি জনস্বাস্থ্যসেবাকে শুধু বাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে না দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য খাতের যথাযথ দায়িত্ব পালন।

এটি মানুষের বাঁচা-মারার বিষয়, এবং সে কারণেই এ ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে করোনা সংক্রমণ রোধের সাফল্য-ব্যর্থতা ছাড়াও এর ব্যাপক তাৎপর্য আছে। সুশাসনের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা উন্নয়ন-অনুন্নয়নের লক্ষণ বুঝতে গেলেও এটা একটা মাপকাঠি হতে পারে।

আরও পড়ুন