বাজারে আগুন লাগায় তাহলে ঘরের বউয়েরাই

ফাইল কার্টুন

কারওয়ান বাজারে আমাদের অফিস ঠিক কাঁচাবাজারের সঙ্গেই। ১২ তলা থেকে তাকালে পুরো কারওয়ান বাজারের একটা রঙিন চিত্র পাওয়া যায়। ওপর থেকে যতটা দৃষ্টিনন্দন, আদতে তা নয়। বিশেষ করে নিচে নেমে দামদর করলে সেই ভালো লাগা হয়তো অনেকেরই থাকবে না। তার ওপর আবার এই বাজারে মাঝেমধ্যেই আগুন লাগে। তবে এই আগুন অন্য রকম। পুরো বাজারে আগুন লাগে না। পণ্য ধরে ধরে আগুন লাগানো হয়। কখনো পেঁয়াজে আগুন লাগে, কখনো নিরীহ লবণে, ভোজ্যতেলে তো প্রায়ই লাগে। এখন যেমন আগুন লেগে আছে চালের বাজারে।

বাজারে আগুন লাগলে সবার আগে মাথায় হাত দেন আসলে গৃহিণীরা। কেননা, সংসার তাঁদেরই চালাতে হয়। আর যাঁদের সামর্থ্য সীমিত, তাঁদের সংকটটা বেশি। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। প্রতিদিন সকালে বাড়ির গৃহিণীকেই ভাবতে হয় বাজারদরের কথা। বাড়ির বউয়ের মেজাজ সারা দিন কেমন থাকবে, তা-ও অনেকটা নির্ভর করে বাজারদরের ওপর।

নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। হঠাৎ একদিন পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করলে অনেককেই দেখলাম এক পাল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ কিনে বাড়ি যেতে। পরদিনই পেঁয়াজের দর দ্বিগুণ হয়ে গেলে গিন্নির মেজাজও দ্বিগুণ। কারওয়ান বাজারে সারা দিন থেকেও এ ধরনের সুযোগ না নেওয়ার ভর্ৎসনা শুনতে হয় প্রতিনিয়ত।

আরও পড়ুন

খুচরা ব্যবসায়ীরা কারওয়ান বাজার থেকে নানা পণ্য কিনে তারপরই বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক বাজারে বেশি দামে সেই পণ্য বিক্রি করেন। একটু কম দামে নিত্যপণ্য কেনার এই সুযোগটা কেন নিচ্ছি না, কথা শুনতে হয় এ নিয়েও। আবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে কেন সাংবাদিক হিসেবে আমরা কঠোর ভাষায় লিখি না, এরও জবাব দিতে হয় প্রতিনিয়ত। সব কথার শেষ কথা, ‘তোমাদের তো আর সংসার সামলাতে হয় না...।’

কাঁচাবাজারে কেন আগুন লাগে বা দ্রব্যমূল্য কেন বাড়ে, এ নিয়ে নানা তত্ত্ব আছে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমিও বাজার, উৎপাদন, জোগান, চাহিদা, সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ী—এর প্রতিটা বিষয় নিয়ে তত্ত্বকথা বলি। আবার তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশ কতটা চলে, সেটা বলতেও ভুলি না। কিন্তু খুব একটা পাত্তা পাওয়া যায় না। তবে এত দিনে পাল্টা জবাব দেওয়ার সময় এসেছে। এত দিন পর জানলাম, বাজারে আগুন বা জিনিসপত্রের লাগামহীন দরের জন্য আসলে দায়ী ঘরের বউয়েরাই।

সামনে রমজান মাস। এ সময় অনেক ধরনের পণ্যের দাম বাড়ে। অনেকেরই আশঙ্কা, বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে সামনে দাম বাড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এই তো ৭ মার্চ প্রথম আলোতেই ছাপা হওয়া সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, দেশে দুশ্চিন্তা’। তবে বিশ্ববাজারের অস্থিরতা যতই থাকুক, তাতে আশঙ্কা নেই। বরং সব আশঙ্কার উৎস ঘরের বউ।

আরও পড়ুন

৭ মার্চই এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় বেশি করে নিত্যপণ্য না কিনতে বা প্যানিক বায়িং) না করতে অনুরোধ করলেন। তিনি সেদিন বললেন, ‘বাড়ির বউয়েরা জিনিসপত্র আগে কিনে রাখতে বলেন। আমার বউও বলেন এমন কথা।’ প্যানিক বায়িংও মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, সবশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী এটাও বলেছিলেন।

প্রথম কথা হচ্ছে, বাজার করা বা বাজারদর নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর স্ত্রী কথা বলেন, সেটা জেনে ভালো লাগল। ঘরের শান্তি বজায় রাখতে এখন বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণে যদি কিছু ব্যবস্থা নেন, তাহলে সেটাই হবে বড় কাজ। তবে সবচেয়ে বড় উপকার করেছেন বাড়ির সব গৃহকর্তার। তাঁরা এবার পাল্টা বলতে পারবেন যে বউয়েরা আগে থেকে কিনে রাখতে বলে বলেই নিত্যপণ্যের বাজারে প্রায়ই আগুন লাগে।

প্যানিক বায়িংয়ের কারণ কী? যদি ভোক্তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে কি না, যেসব দেশের ওপর বাংলাদেশ নির্ভরশীল, সেসব দেশের উৎপাদন পরিস্থিতি সম্বন্ধে পূর্বাভাস করতে না পারে, বিকল্প আমদানির পরিকল্পনা না থাকে, তাহলেই ভোক্তাদের মধ্যে প্যানিক বায়িংয়ের প্রবণতা দেখা দেয়। এসব কথা আরও বিস্তারিত বলা যেত হয়তো, কিন্তু চুপ থাকাই ভালো। কেননা, আসল কারণ তো জানাই গেল। ঘরে বউয়েরাই এর জন্য দায়ী।

অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে কিন্তু বেশ কিছু আইন আছে। যমন, ‘দ্য এসেনশিয়াল আর্টিকেলস অ্যাক্ট, ১৯৫৩’, ‘কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট, ১৯৭৬’, ‘অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৮১’, ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১’ ইত্যাদি। আরও আছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯। ব্যবস্থা আছে ভ্রাম্যমাণ আদালতেরও। এখন তাহলে প্রয়োজন ‘ঘরের বউদের আগাম পণ্য কিনে রাখার প্রতিরোধ আইন-২০২১ ’। তাহলেই সব মুশকিলের আসান।