সরকারি ঋণের সুদ ১১%, বাড়বে ব্যাংকঋণের সুদ 

  • গতকাল অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে ৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকা ধার করেছে সরকার।

  • ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ধারের লক্ষ্য ছিল সরকারের, তবে নিয়েছে ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত
সরকার এখন টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিচ্ছে না; বরং ঋণের জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে ঋণের সুদহার বাড়ছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়া বন্ধ করেছে সরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিবর্তে এখন ভাঙানো হচ্ছে বেশি। রাজস্ব আদায়ও কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। ফলে সরকারের খরচ চালানোর জন্য প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে ব্যাংক। এ জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে সরকার, যা দিন দিন বাড়ছে। এতে ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত নিলামে বিভিন্ন মেয়াদি বিলের সুদহার ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এই নিলামের মাধ্যমে ৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকা ধার করেছে সরকার।

এদিকে ট্রেজারি বিলের ওপর নির্ভর করে এখন ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়। ফলে নতুন বছরের শুরুতে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ডিসেম্বর মাসের জন্য স্মার্ট রেট হচ্ছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিতে পারে। ফলে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেড়ে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার বেড়ে ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশে উঠেছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনে সরকারের খরচ কত হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে ঋণের সুদহার। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যা, তাতে সরকার আরও বেশি টাকা তুলবে। ফলে সুদের হার আরও বাড়বে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সুদহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এখানে সরবরাহ ব্যবস্থা, জোগান, বাজার তদারকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ 

ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লে উৎপাদন খাত ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিতে পারে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য ঋণের অপব্যবহার ও উৎপাদন খাতের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি শুরু করা প্রয়োজন। তাহলে সংকট থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।
মোস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

মোস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লে উৎপাদন খাত ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিতে পারে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য ঋণের অপব্যবহার ও উৎপাদন খাতের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি শুরু করা প্রয়োজন। তাহলে সংকট থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।’ 

জানা গেছে, গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা আগে ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার আগের ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে, ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ২০ শতাংশে উঠেছে। 

গতকাল ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার লক্ষ্য ছিল সরকারের, তবে শেষ পর্যন্ত তোলে ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। এ কারণেই সুদহার বেড়ে যায় বলে সূত্রগুলো জানায়।

১৮২ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে দেড় হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা করলেও সরকার শেষ পর্যন্ত তোলে ৫০১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা থাকলেও সরকার নিয়েছে ৪২২ কোটি টাকা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ধারণা, ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। তবে সুদহার বাড়লে ঋণ বিতরণ কমে এবং তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। 

চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য সম্প্রতি নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। নতুন রেপো রেট দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। ৫ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর রয়েছে। এর পর থেকে সব ধরনের সুদের হার বাড়ছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য সুদহার আরও বাড়বে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের জমি ক্রয় এবং কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি ক্রয় ও তাঁদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি টাকা ছাপানোও এখন বন্ধ রয়েছে। এসব উদ্যোগ কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হাতে থাকা সব ধরনের অস্ত্রও ব্যবহার করা প্রয়োজন।