সর্বজনীন পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হবে ট্রেজারি বিল–বন্ডে

১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়। এ নিয়ে গতকাল প্রথমবারের মতো আলোচনা সভার আয়োজন করে মেট্রো চেম্বার বা এমসিসিসিআই।

গ্রাফিকস
প্রথম আলো

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির চাঁদার অর্থ নিরাপদ খাতেই বিনিয়োগ করা হবে। প্রাথমিকভাবে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে এ অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান।

কবিরুল ইজদানী খান বলেন, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীনে দুটি তহবিল থাকবে। একটি তহবিলে সরকার সরাসরি অর্থ দেবে। সেই অর্থ দিয়েই জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অফিসের ব্যয় বহন করা হবে। অন্য তহবিলে জমা হবে পেনশনের চাঁদার অর্থ। সেই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ হবে, সেটি নির্ধারণ করবে তহবিল ব্যবস্থাপনা কমিটি। সেই কমিটিতে ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিসহ অনেকে থাকবেন। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত ও নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করা হবে, যাতে করে এ অর্থ সুরক্ষিত থাকে এবং মুনাফাও হয়। ভবিষ্যতে একসময় এই তহবিলে অর্থ জমা অনেক বেড়ে যাবে। তখন প্রয়োজনে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিকল্পনাও আছে।

আরও পড়ুন

ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা এমসিসিআইয়ের রাজধানীর মতিঝিল কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত সর্বজনীন পেনশন নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন কবিরুল ইজদানী খান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সায়ফুল ইসলাম। এতে বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সর্বজনীন পেনশন নিয়ে উপস্থিত অনেকের প্রশ্নের জবাব দেন কবিরুল ইজদানী খান। সরকার পরিবর্তন হলে এই পেনশন কর্মসূচি থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার পরিবর্তন, সরকারের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও সরকারের উন্নয়ন একটি প্রেক্ষিত। আরেকটি প্রেক্ষিত হচ্ছে, জনগণ কী চায়। জনগণ তাঁর আয়ের নিশ্চয়তা চান। পেনশন কর্মসূচির বড় বিষয় হচ্ছে আস্থা। সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নিচ্ছেন; কেউ বাধ্য করছে না। সরকার উদ্যোগ নিয়ে এটি চালু করেছে। যাঁরা পেনশনের চাঁদা জমা দিচ্ছেন, সেটি তাঁদের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। সেই অর্থ পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে, জমাকৃত অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে মুনাফাসহ ফেরত দেওয়া।’

আরও পড়ুন

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে কবিরুল ইজদানী খান বলেন, ‘পেনশন হচ্ছে সুরক্ষা, সম্পত্তি নয়। পেনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বর্তমানের আয় থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা করলে অবসরকারকালে ভাতা পাওয়া যাবে, যা বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ফলে জমিজমা কিংবা অন্য কোনো সম্পদের সঙ্গে পেনশনকে তুলনা করা ঠিক হবে না। পেনশনের অর্থের হেফাজতকারী হচ্ছে সরকার। তবে চাঁদাদাতার নামেই অর্থ জমা হবে। পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা জমার চেয়ে পাবেন বেশি। এই হিসাব-নিকাশে মূল্যস্ফীতিও আছে। তিনি আরও বলেন, বাজারে সঞ্চয়ের অনেক পণ্য আছে। যেটি ভালো সেটি গ্রহণ করবেন। পেনশন কর্মসূচিতে কোনো ত্রুটি থাকলে তুলে ধরবেন। আমরা এটিকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে চাই।’

আরও পড়ুন

পেনশন এককালীন উত্তোলনযোগ্য নয়

সরকারি কর্মচারীরা অবসরে গেলে পেনশনের একটি অংশ এককালীন তুলতে পারেন। তবে সেই সুযোগ থাকবে না সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে। যদিও চাঁদাদাতা ব্যক্তি চাইলে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা, বাড়ি নির্মাণ বা মেরামত ও সন্তানের বিয়ের খরচের জন্য পেনশন বাবদ জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। যা পেনশন কর্তৃপক্ষের ধার্য করা ফিসহ সর্বোচ্চ ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

এমসিসিআইয়ের আলোচনায় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা এমনটাই জানান। তাঁরা আরও জানান, বর্তমানে চারটি কর্মসূচি বা স্কিমের মাধ্যমে পেনশন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রগতি কর্মসূচিতে (বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য) বেশি সাড়া মিলছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য চালু হওয়া সমতা কর্মসূচিতে চাঁদাদাতা দেবেন ৫০০ টাকা। বাকি ৫০০ টাকা দেবে সরকার। যাঁদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম, তাঁরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। তবে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে থাকা ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ যাঁরা বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন, তাঁরা এই সমতা কর্মসূচির বাইরে থাকবেন আপাতত।

আরও পড়ুন

কর্মসূচি বা চাঁদা পরিবর্তন যখন খুশি

পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো ব্যক্তি প্রগতি কর্মসূচিতে (স্কিম) চাঁদা প্রদান শুরুর পর যদি কখনো ব্যবসা শুরু করেন, তখন তিনি আবার সুরক্ষা কর্মসূচিতে স্থানান্তরিত হতে পারবেন। অন্য কর্মসূচির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এমনকি মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে আসা কোনো চাঁদাদাতা যদি চাঁদার হার কম বা বেশি করতে চান, তা–ও করতে পারবেন। মূলত চাঁদাদাতার ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত যে অর্থ জমা হবে, তার সঙ্গে মুনাফা যুক্ত করে মাসিক ভিত্তিতে আজীবন পেনশন দেবে কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে প্রবাসীদের জন্য চালু হওয়া প্রবাস কর্মসূচিতে বর্তমানে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডধারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই কর্মসূচিতে নিবন্ধন ও চাঁদা দিতে পারছেন। ভবিষ্যতে অন্যরাও পারবেন। মার্কিন ডলারে পেনশনের চাঁদা দেওয়ায় আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কখনো যদি তাঁরা স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন, তাহলে পেনশন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। তাহলে তিনি টাকায় কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন।

আরও পড়ুন

কবিরুল ইজদানী খান বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার অর্থ যেভাবে গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে যায়, একইভাবে পেনশনের অর্থ মাসে মাসে চাঁদাদাতার ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের পেনশন কর্মসূচিতে যুক্ত করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কর্মীরা তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করবে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো কোম্পানিতে চাকরি নিলেও সংশ্লিষ্ট কর্মীর পেনশন কর্মসূচি বহাল থাকবে।

স্বাগত বক্তব্যে এমসিসিআইয়ের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের জন্য ভবিষ্য তহবিল ও গ্র্যাচুইটি চালু আছে। তারা চাইলে এসবের পাশাপাশি পেনশন কর্মসূচি চালু করতে পারে। সরকার এখানে জিম্মাদার হিসেবে রয়েছে। অনেক কোম্পানিতে ভবিষ্য তহবিল ও গ্র্যাচুইটির অর্থ পাওয়া নিয়ে অবিশ্বাস আছে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন অনন্য; কারণ, এটির দায়দায়িত্ব সরকারের।

পেনশনের টাকা পেতে জুতার তলা ক্ষয় হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জুতার তলা ক্ষয় হওয়ার দিন শেষ। এখন আঙুল ক্ষয় করতে হবে। কারণ, টাকা ও বিতরণ অনলাইনেই হবে।