সর্বজনীন পেনশন কোন দেশে কেমন

বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে বিভিন্ন ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশেষে তা আলোর মুখ দেখতে চলেছে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ইতিমধ্যে তৈরি করেছে একটি কৌশলপত্র ও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া।

দেরিতে হলেও বাংলাদেশে সবার জন্য পেনশন অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দেড় মাস আগে এ ব্যাপারে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থ বিভাগ গত সপ্তাহে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের একটি খসড়াও তৈরি করেছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি থাকায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি শুরু করার এটাই প্রকৃত সময়।’

বিশ্বজুড়ে সাধারণত আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (ডিসি)—এই চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এটির জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে অবশ্য বিমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশনব্যবস্থা চালু আছে।

বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরনের সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যেমন বললেন, ‘বিষয়টি সমীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে।’ মতামতের জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়াটি ইতিমধ্যে ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে। কৌশলপত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পেনশনব্যবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ।

ভারতে ২০০৪ সালে শুরু

প্রতিবেশী ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশনব্যবস্থা (এনপিএস) চালু করা হয়। শুরুতে সামরিক বিভাগ ছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য চালু করা হয় এটি। গ্রাহক ও নিয়োগকর্তা বা সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দেয় এনপিএসে, যা পরে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এতে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার সময় ৬০ শতাংশ অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ পেনশন প্রদানের সুযোগ তৈরি করা হয়।

ভারত ২০০৯ সালের ১ মে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী সব নাগরিকের জন্য পেনশনব্যবস্থা উন্মুক্ত করে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও পেনশন–সুবিধায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে একটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে আরেকটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত।

মাঝখানে ২০১৩ সালে সরকারি ব্যবস্থায় এনপিএস চালুর জন্য পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (পিএফআরডিএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্য সামাজিক পেনশনব্যবস্থাও চালু রয়েছে।

‘দেরিতে নেওয়া হলেও উদ্যোগটি ইতিবাচক। অন্তত শুরু হোক। তারপর অনেক ভুলত্রুটি বেরিয়ে আসবে, যা পরে সংস্কার করতে হবে। দেশে দেশে তা–ই হয়েছে।’
আহসান এইচ মনসুর, (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক

এশিয়ায় তুলনামূলক এগিয়ে চীন

চীনে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম। দেশটিতে তিন ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরে কর্মরতদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিতদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) চালু রয়েছে দেশটিতে।

ইউপিএস বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক—দুই ধরনেরই রয়েছে। এদিকে সরকারি ক্ষেত্রে ডিবি এবং গ্রাম ও শহুরেদের ক্ষেত্রে ডিসি পদ্ধতি চালু রয়েছে চীনে।

ইউপিএসে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্মচারীর মূল বেতনের ২০ শতাংশ দেয়। আর কর্মচারী দেন তাঁর মূল বেতনের ৮ শতাংশ। আরপিএস সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক। এতে সরকার ও ব্যক্তি উভয় অংশই নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা করে, যা থেকে মাসিক পেনশন দেওয়া হয়। সিপিএসপিএস সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয়।

যুক্তরাজ্যে চার ধরনের পেনশন

দেশটিতে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড—এই চার ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পেনশনেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতা, সম্পূরক পেনশন ও পেনশন ক্রেডিট নামক তিনটি অংশ। রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতার আওতায় যাঁদের বার্ষিক আয় ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি, তাঁদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয় জাতীয় বিমায়। যাঁদের আয় রাষ্ট্রনির্ধারিত নিম্ন আয়সীমার নিচে তাঁদের দেওয়া হয় সম্পূরক পেনশন। এটা ঐচ্ছিক। আর পেনশন ক্রেডিট হচ্ছে, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য, যাঁদের আয় কম।

পেশাগত পেনশন হচ্ছে কর্মীর বেতন থেকে ৩ শতাংশ এবং সরকার বা কোম্পানি থেকে ৫ শতাংশ জমা হওয়ার পদ্ধতি। এটা বিনিয়োগ করে মুনাফার টাকাসহ পেনশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়া হয় সব সামরিক, সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের। আর ব্যক্তিগত পেনশন হচ্ছে বিমা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত একটি পদ্ধতি।

যুক্তরাষ্ট্রে ৯৪% সামাজিক নিরাপত্তায়

এ দেশেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে করে জমা অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়।

চাকরিভিত্তিক পেনশনের আওতায় কর্মী যা দেবেন, তার সমপরিমাণ দেবে সরকার বা কোম্পানি। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতি ও ব্যক্তিগত পেনশনব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের মতোই।

অন্যান্য দেশের উদাহরণ

অর্থ বিভাগের তৈরি করা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, উন্নত দেশ হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বাজেট থেকে সবাইকে পেনশন দেওয়া হয়। জাপান, হংকং, কোরিয়া ও তাইওয়ানের পরিস্থিতিও উন্নত দেশগুলোর মতোই। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম পেনশন সংস্কার করছে। ফিলিপাইন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া অংশগ্রহণমূলক পেনশন পদ্ধতি শুরু করেছে।

সার্বিকভাবে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেরিতে নেওয়া হলেও উদ্যোগটি ইতিবাচক। অন্তত শুরু হোক। তারপর অনেক ভুলত্রুটি বেরিয়ে আসবে, যা পরে সংস্কার করতে হবে। দেশে দেশে তা–ই হয়েছে।’