গ্রাহকেরা ঘুরছেন এখানে- সেখানে, টাকা ফেরত পাচ্ছেন না

বিভিন্ন গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানে আটকে ছিল গ্রাহকের ৫২৫ কোটি টাকা। তার মধ্য ২১৫ কোটি টাকা এখনো আটকা।

ই–কমার্সপ্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঘটা করেই বলেছিল, ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালের ৩০ জুনের পরে যাঁরা পণ্য কিনতে টাকা দিয়েছিলেন, তাঁরা সেই টাকা ফেরত পাবেন। অথচ দেড় বছরে ৫২৫ কোটি টাকা থেকে গ্রাহকেরা ফেরত পেয়েছেন মাত্র ৩১০ কোটি টাকা। বাকি ২১৫ কোটি টাকা এখনো পাননি তাঁরা। এই টাকা ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লেনদেন পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানে (পেমেন্ট গেটওয়ে) আটকে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ‘এসক্রো’ ব্যবস্থা চালু করে ২০২১ সালের ৩০ জুন। গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ নিশ্চিত করতে এই এসক্রো ব্যবস্থা চালু করা হয়। গত বছরের ৩০ জুনের পর প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ২৭ ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকাও করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকেরা বলছেন, পাওনা ফেরত পেতে সব জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন তাঁরা, কিন্তু টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও গ্রাহকদের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে কোনো সুরাহা আর হচ্ছে না।

এমন বাস্তবতায় করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে গত সপ্তাহে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান। বৈঠকে উঠে আসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে আটকে থাকা গ্রাহকের টাকা জমা রয়েছে পাঁচ পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানে। এগুলো হচ্ছে বিকাশ, নগদ, সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), সূর্যমুখী লিমিটেড এবং ফস্টার করপোরেশন।

যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের মামলা রয়েছে, সেগুলোর টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন। এরপরও পথ বের করার ব্যাপারে কাজ চলছে।
তপন কান্তি ঘোষ, বাণিজ্যসচিব

আইন মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ভেটিং) করানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নিয়েও টাকা ফেরত দেওয়া কেন সম্ভব হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে গত সোমবার বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের মামলা রয়েছে, সেগুলোর টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন। এরপরও পথ বের করার ব্যাপারে কাজ চলছে।’

ফেরত দেয়নি যারা

২৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি ২৫ হাজারের বেশি গ্রাহকের কোনো টাকাই ফেরত দেয়নি। আর ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফেরত দিয়েছে গ্রাহকের আংশিক টাকা। যেসব প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দেয়নি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিরাজগঞ্জ শপ, নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেটি, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশ নীল, আলাদীনের প্রদীপ, সফেটিক, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম এবং ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেড ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে ইভ্যালি। তবে এ প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনাদার গ্রাহকদের সংখ্যা এখনো চিহ্নিত হয়নি।

ইভ্যালি, ই–অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদীনের প্রদীপ, সফেটিক গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে পুরোনো গুদাম থেকে পণ্য সরিয়ে নিয়েছে কিউকম।

আরও পড়ুন

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আলাদীনের প্রদীপ ও সিরাজগঞ্জ শপের ব্যাংক হিসাব জব্দ। ফলে তারা টাকা ফেরতের উদ্যোগ নিতে পারেনি। আর ধামাকা শপিংয়ের আন্তকোম্পানি ঋণ রয়েছে। ঋণের তথ্য দিতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ সময় চেয়েছে।

বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক আনোয়ার উল্লাহ জানান, সিরাজগঞ্জ শপ ও নগদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ কারণে টাকা আটকে আছে। একই বৈঠকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) যুগ্ম পরিচালক ওমর শরীফ জানান, সিরাজগঞ্জ শপ, দালাল প্লাস, ধামাকা শপিং ও আলাদীনের প্রদীপের মধ্যে শুধু আলাদীনের প্রদীপের ব্যাংক হিসাবে আছে পাঁচ কোটি টাকার বেশি।

কোন গেটওয়েতে কত টাকা

বেশিসংখ্যক ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্থ লেনদেনের জন্য মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ও সফটওয়্যার শপ লিমিটেডকেই (এসএসএল) পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে বেছে নিয়েছিল। যদিও পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে রয়েছে ফস্টার করপোরেশনে। প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ ৩৮২ কোটি টাকা।

এ ছাড়া এসএসএলে ৮৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, সূর্যমুখী লিমিটেডে ২৬ কোটি ২১ লাখ টাকা, নগদে ২০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং বিকাশে ৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা আটকে থাকার তথ্য রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে।

কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রিপন মিয়া বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তালিকা জমা দেওয়া আছে। নতুন করে আরও আট কোটি টাকা পরিশোধের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

এদিকে ইভ্যালিতে আটকে আছে গ্রাহকদের ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদে ১৮ কোটি, বিকাশে প্রায় ৫ কোটি এবং এসএসএলে ৩ কোটি টাকা জমা রয়েছে। আর এসএসএলে আটকে আছে ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের ৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ই-কমার্সবিষয়ক গবেষক সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, ‘গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য শুরুর দিকে সরকার যেভাবে উদ্যোগী ছিল, এখন সেই উদ্যোগে একটু ভাটা দেখা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদে দক্ষ ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়ে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে।’