৪০ হাজার পরিবার, চাল সামান্য

চাহিদার তুলনায় চাল ও আটার বিক্রি অপ্রতুল। কড়াইল বস্তিতে ওএমএসের ট্রাক এলেই লাগে হুড়োহুড়ি।

সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ওএমএসের চাল ও আটা পেতে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের সারি। নির্ধারিত স্থানে ট্রাক এলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন তাঁরা। গতকাল রাজধানীর কড়াইল বস্তির বেলতলায়ছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তিতে কমবেশি ৪০ হাজার পরিবারের বসবাস। এ হিসাব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। এক পরিবারে চারজন করে সদস্য ধরলে এ বস্তিতে বসবাস দেড় লক্ষাধিক মানুষের। এঁদের সবাই নিম্ন আয়ের। অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস এসব মানুষের। এসব মানুষের খাওয়ার খরচের বড় অংশই ব্যয় হয় চাল কেনায়। তাই বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে সংকটে পড়েছেন এই বস্তির বাসিন্দারা।

এদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি দামে চাল-আটা বিক্রির উদ্যোগ নেয়। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেল বা ওএমএসের ট্রাকের মাধ্যমে রাজধানীর ৭০টি স্থানে বিক্রি করা হয় এ দুই পণ্য। তবে কড়াইল বস্তি এলাকায় ওএমএসের ট্রাকে পণ্য বিক্রির পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। সপ্তাহে ছয় দিনে এক ট্রাক করে ওএমএসের চাল-আটা বিক্রি হয় এই বস্তি এলাকায়। দুই স্থানে তিন দিন করে ছয় দিন এসব ট্রাক যায়। প্রায় অর্ধলক্ষ পরিবারের চাহিদার তুলনায় যা খুবই নগণ্য।

ওএমএসের ট্রাক থেকে একজন মানুষ দিনে পাঁচ কেজি চাল ও দুই কেজি আটা কিনতে পারেন। পূর্ণবয়স্ক চার সদস্যের একটি পরিবারে দিনে দুই বেলা ভাতের জন্য কেজি দেড়েক চাল লাগে। বস্তি এলাকার বেশির ভাগ মানুষ পেটভরে ভাত খান। তাই পাঁচ কেজি চালে একটি পরিবারের তিন দিনের মতো যায়।

আগে তো এত লোক হতো না। এখন প্রতিদিনই লোক বাড়ছে। তাই ওএমএসে চাল ও আটার বরাদ্দ বাড়াতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব।
সুরাইয়া খাতুন, প্রধান নিয়ন্ত্রক, ঢাকা রেশনিং দপ্তর

গতকাল রোববার বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কড়াইলের বেলতলা এলাকায় ওএমএসের ট্রাকের সামনে দেখা যায়, চাল-আটা কেনার জন্য কয়েক শ মানুষের হুড়োহুড়ি লেগেই ছিল। পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়ানো ২০ থেকে ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহে তিন দিন বেলতলা এলাকায় ওএমএসের ট্রাক আসে। দিনে এক ট্রাক পণ্য বিক্রি হয়। প্রতি ট্রাকে থাকে দুই হাজার কেজি চাল ও এক হাজার কেজি আটা। তাই পণ্য কিনতে ভোর থেকে লোকজন জড়ো হন ট্রাকের লাইনে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ট্রাকে পণ্য কম থাকে বলে সবাই কিনতে পারেন না। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহের আরও তিন দিন কড়াইলের বস্তি এলাকার মানুষ ওএমএসের পণ্য পান। পল্লিবন্ধু এরশাদ বিদ্যালয়ের মাঠে ওই তিন দিন ওএমএসের ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হয়। দিনে সর্বোচ্চ ৪০০ পরিবার চাল পায়। আর আটা পায় ৫০০ পরিবার। সেই হিসাবে বস্তির মোট ২ হাজার ৪০০ পরিবার সপ্তাহে ছয় দিন চাল পাওয়ার কথা। আর ৩ হাজার পরিবারের আটা পাওয়ার কথা। তাতে ওই বস্তি এলাকার পরিবারের মধ্যে সপ্তাহে পণ্য পায় মাত্র ৬ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পরিবার। কিন্তু বাস্তবে এ ঘটনা ঘটে না। কারণ, কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা ছাড়াও ওএমএসের ট্রাক থেকে আশপাশের বাসিন্দারাও পণ্য কেনে।

তাই কড়াইল বস্তির মানুষের মুখে ওএমএসের পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে বারবার। স্থানীয় বাসিন্দা গাড়িচালক সোহেল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে চাল-আটা যেটুকু দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাই প্রতিদিনই অনেকে চাল-আটা না পেয়ে খালি হাতে ফেরেন।’

কড়াইল বস্তির একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দামের চাপে তাঁরা পিষ্ট। বেশির ভাগ পরিবারই চলে দিন এনে দিন খেয়ে। তাই সরকারের ভর্তুকি মূল্যের চাল ও আটা কিনতে লম্বা সারি থাকে ওএমএসের ট্রাকের সামনে।

কড়াইল বস্তির বাসিন্দা হিমানী আক্তার। মধ্যবয়সী এই নারীর দাবি, দেড় মাস ধরে কড়াইলে আসা ওএমএসের ট্রাক থেকে চাল ও আটার কেনার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। প্রথম আলোকে হিমানী আক্তার বলেন, ‘ঘরে বাচ্চা আছে। কাজ আছে। তাই সকাল থেকে পুরোটা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। এ জন্য আমি পণ্য পাই না।’

চলতি মাসের ১১ দিনে কড়াইলের বেলতলায় চার দিন ও এরশাদ স্কুলের মাঠে তিন দিন ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ১১ দিনে ৭ দিন, ৭টি ট্রাক এই বস্তিবাসীর কাছে পণ্য বিক্রি করেছে। নভেম্বর মাসে এই দুই স্থানে ৩২টি ট্রাক পণ্য বিক্রি করেছিল।

জানতে চাইলে ওএমএসের দায়িত্বে থাকা ঢাকা রেশনিং দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো এত লোক হতো না। এখন প্রতিদিনই লোক বাড়ছে। তাই ওএমএসে চাল ও আটার বরাদ্দ বাড়াতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব।’

বাজারে চাল ছাড়া আটা, ময়দা, ডাল, চিনি, সয়াবিনসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পণ্যের দাম। তাতে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। অবশ্য নভেম্বরে তা কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বাজারে এখনো স্বস্তি নেই।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, বস্তিবাসী মানুষের আয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় ঘরভাড়ায়। এর মধ্যে কড়াইল বস্তিতে বসবাসকারীদের আয়ের প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয় বাসাভাড়া বাবদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম।

এ ছাড়া বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গত জুনের অন্য আরেক জরিপে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২১ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। আর মাসে অন্তত এক দিন বস্তিবাসীর ৫ শতাংশ মানুষ অভুক্ত থাকে।

প্রতিদিনই খালি হাতে ফিরছেন মানুষ

এদিকে প্রতিনিয়ত ওএমএসের ট্রাকের সামনে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য কিনতে না পেরে বহু মানুষ খালি হাতেও ফিরছেন। গতকাল মিরপুর-২ এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, ওএমএসের ট্রাকে দুপুরেই আটা বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আর বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে চাল বিক্রি। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯ জন নারী-পুরুষ চাল-আটা কোনোটাই না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যান।

এমন চিত্র রাজধানীর প্রায় সব কটি ওএমএসের ট্রাকেই। গত এক মাসে ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় ওএমএসের ট্রাকে পণ্য বিক্রি পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। এতে দেখা গেছে, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও প্রায় প্রতিটি ট্রাক থেকে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এ অবস্থায় রাজধানীতে ওএমএসের ট্রাকের সংখ্যা ২০টি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৭০টি ট্রাকে করে ওএমএসের পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন