২ লাখ কোম্পানি, পরিদর্শক ৬

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এই ভবনেই যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) কার্যালয়।
ছবি: সংগৃহীত

গ্রুপ টোয়েন্টি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল, কোম্পানির ঠিকানা, পরিচালকদের তথ্য জমা দিয়েই এক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধন পেয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। ব্যবসার ধরন হিসেবে বলা হয় গাজীপুরের পুবাইলে রিসোর্ট ও কৃষি ব্যবসার কথা। গত দুই বছরে ওই কোম্পানি ব্যবসা শুরু করতে পারেনি। পুবাইলে এক বিঘা কৃষিজমি ছাড়া কিছুই নেই।

যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) শুধু নিবন্ধন দিয়েই বসে থাকে। ফলে নিবন্ধন নিয়ে হাজার হাজার কোম্পানি হয়ে আছে শুধু ‘কাগুজে’ কোম্পানি। এসব কোম্পানি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করল কি না, ব্যবসা শুরু করল কি না, পরিচালকদের ব্যবসা পরিচালনায় সক্ষমতা কেমন—এসবের কোনো খোঁজ নেন না আরজেএসসির কর্মকর্তারা।

কয়েক মাস আগে আরজেএসসির সহায়তায় অস্তিত্বহীন প্রায় ৮০ হাজার কোম্পানির খোঁজ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশেষ টাস্কফোর্স। যেসব কোম্পানির কোনো কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই। এর মধ্যে কারওয়ান বাজারের আরজেএসসি ভবনের পাশের দুটি ভবনে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এসব কোম্পানির কোনো কার্যালয় ওই দুটি ভবনে নেই। অস্তিত্বহীন এসব কোম্পানি চিহ্নিত করতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে আরজেএসসি। কিন্তু কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংস্থাটি। তবে কোম্পানিগুলোকে টিআইএন দিচ্ছে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর কার্যালয়।

কারওয়ান বাজারের দুটি ঠিকানা ব্যবহার করে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। এভাবে একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
শেখ শোয়েবুল আলম, নিবন্ধক, আরজেএসসি

কেন এই দশা, জানতে আরজেএসসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বর্তমানে ১ লাখ ৮৬ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানির নিবন্ধন, রিটার্ন জমা তদারক, সার্বিক পরিচালনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য মাত্র ৬ জন পরিদর্শক রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা কার্যালয়ে পাঁচজন এবং রাজশাহী কার্যালয়ে একজন পরিদর্শক আছেন। চট্টগ্রাম ও খুলনা কার্যালয়ে কোনো পরিদর্শক নেই। তবে পরিদর্শক-সংকটের কারণে আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া তথ্য এবং কোম্পানির প্রস্তাবিত ঠিকানা সরেজমিনে যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেদার নিবন্ধন দেওয়া হয়। শুধু করোনার বছরে, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়া ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরেজমিন যাচাই-বাছাই করে কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়ার মতো লোকবল নেই। তাই আবেদনপত্রের কাগজপত্র ঠিক থাকলেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। নিজেদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘কারওয়ান বাজারের দুটি ঠিকানা ব্যবহার করে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। এভাবে একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’

লোকবল ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে যাচাই-বাছাই না করেই নির্বিচার কোম্পানি নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি মনে করেন, বছরে হাজার হাজার কোম্পানি নিবন্ধন নিচ্ছে, নিবন্ধন নেওয়ার পর সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার দায়িত্বও আরজেএসসির। তারা এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

আরজেএসসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নামের ছাড়পত্র পাওয়া গেলে কোম্পানির জন্য আবেদন করা হয়। প্রস্তাবিত কোম্পানির ঠিকানা, পরিচালকদের কর শনাক্তকরণ নম্বরসহ (টিআইএন) বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র দিতে হয়। এসব কাগজপত্র ভুয়া কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বেশি কোম্পানি নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেন উদ্যোক্তারা। কারওয়ান বাজারের আরজেএসসি ভবনের আশপাশের বিভিন্ন ভবনেই এমন শতাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সম্প্রতি কয়েকটি ভবনে সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতি তলায় ছোট ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে চলে এসব আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা আইনজীবীর কার্যালয়। শাহ আলী টাওয়ারের বিভিন্ন তলায় ঘোরাফেরা করতেই দু-এক জন কর্মী এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী কাজে এসেছেন?’ কোম্পানি করার সব ধরনের সহায়তা করা হয় বলে জানান তাঁরা।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, লোকবল ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে যাচাই-বাছাই না করেই নির্বিচার কোম্পানি নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি মনে করেন, বছরে হাজার হাজার কোম্পানি নিবন্ধন নিচ্ছে, নিবন্ধন নেওয়ার পর সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার দায়িত্বও আরজেএসসির। তারা এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত নামে কোম্পানির ‘নামের ছাড়পত্র’ না-ও পাওয়া যেতে পারে, এ আশঙ্কায় অনেকে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে বসে থাকেন। নিবন্ধন নেওয়ার পর টাকা জোগাড় করতে না পেরে অনেকে কোম্পানি চালু করেন না।
আবুল কাসেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

দিনে ৪৯টি কোম্পানি নিবন্ধন

করোনার কারণে গত দেড় বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙা ভাব নেই। নতুন বিনিয়োগেও তেমন আগ্রহ নেই উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
যৌথ মূলধনি ও কোম্পানিসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ হাজার ১২৫টি কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ২১০টি কোম্পানিকে আবেদন করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।

গত অর্থবছরে ছুটির দিন বাদে মোট কর্মদিবস ছিল ২৪৭টি। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৪৯টির বেশি কোম্পানিকে নিবন্ধন দিয়েছে আরজেএসসি। সর্বশেষ হিসাবে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে মোট ১ হাজার ৩৬৫টি কোম্পানিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বা শিল্পগোষ্ঠী সহযোগী কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে রাখলেও উৎপাদন বা পরিচালনায় যায় না বলে জানা গেছে।

বেশ কয়েকটি কারণে কোম্পানি চালু করা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত নামে কোম্পানির ‘নামের ছাড়পত্র’ না-ও পাওয়া যেতে পারে, এ আশঙ্কায় অনেকে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে বসে থাকেন। নিবন্ধন নেওয়ার পর টাকা জোগাড় করতে না পেরে অনেকে কোম্পানি চালু করেন না। করোনায় অর্থনীতি শ্লথগতি, তাই অনেকে এই মুহূর্তে কোম্পানি চালু করাকে ঝুঁকি মনে করছেন।

বিলম্ব মাশুল দিয়ে রিটার্ন দেওয়ার আইনি সুযোগ থাকায় অনেক কোম্পানি মালিক নিয়মিত রিটার্ন দেন না। অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি নিবন্ধন নিলেও পরে আর তা চালু করেননি। ফলে এসব কোম্পানি কাগুজে হয়ে গেছে।
শেখ শোয়েবুল আলম, নিবন্ধক, আরজেএসসি

এক লাখ কোম্পানির খবর নেই

আরজেএসসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গত জুন মাস পর্যন্ত দেশে এক লাখ ৮৬ হাজার ৮২৫টি প্রাইভেট কোম্পানি আছে। সবার প্রতিবছর বার্ষিক রিটার্ন দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৪০ শতাংশ বা ৭৪-৭৫ হাজার কোম্পানি নিয়মিত রিটার্ন দেয়। এই সংখ্যা কখনো কখনো ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। বাকি এক লাখ কোম্পানি রিটার্ন দেয় না। ফলে কোম্পানিগুলো সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো খোঁজ জানে না আরজেএসসি।

এ বিষয়ে আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, ‘বিলম্ব মাশুল দিয়ে রিটার্ন দেওয়ার আইনি সুযোগ থাকায় অনেক কোম্পানি মালিক নিয়মিত রিটার্ন দেন না। অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি নিবন্ধন নিলেও পরে আর তা চালু করেননি। ফলে এসব কোম্পানি কাগুজে হয়ে গেছে। আইনি জটিলতার কারণে আমরাও ব্যবস্থা নিতে পারি না।’

কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়ার পর কত দিনের মধ্যে পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করতে হবে, সে বিষয়ে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিবছর রিটার্ন বা বার্ষিক বিবরণী জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আইনি ফাঁকফোকরের কারণে অনেক কোম্পানি নিয়মিত রিটার্ন দেয় না। নিয়ম অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যদি বার্ষিক বিবরণী আরজেএসসিতে জমা দিতে না পারে, তাহলে প্রথম তিন বছরে প্রতিবছরের জন্য ৫০০ টাকা এবং ৩ বছর পর প্রতিবছরের জন্য ৭০০ টাকা বিলম্ব মাশুল আরোপের বিধান রয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর রিটার্ন না দিয়েও পার পাওয়া যায়।

সম্প্রতি লোকবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে আরজেএসসি। এ নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন আরজেএসসির কর্মকর্তারা। বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ে ৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এটি তিন থেকে চার গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে নতুন জনবলকাঠামো পাস হতে এক বছরের মতো সময় লাগবে।

আরও পড়ুন