কারওয়ান বাজারের দুই ভবনে ১৪০০ কোম্পানি

প্রায় ৮০ হাজার কোম্পানি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েও কর দেয়নি। এসব কোম্পানি টিআইএন নেয়নি, রিটার্নও দেয়নি।

ভবন দুটির ঠিকানা ব্যবহার করে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। তাজ ম্যানশন (বাঁয়ে), ডানে শাহ আলী টাওয়ার। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে।ছবি: প্রথম আলো

কারওয়ান বাজারের একটি ভবনের নাম তাজ ম্যানশন। ভবনের ঠিকানা ২৮, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। চারতলা এই ভবন বেশ পুরোনো ও জরাজীর্ণ। প্রতিটি তলা স্যাঁতসেঁতে, আলো কম। অথচ এ ঠিকানা ব্যবহার করে বিভিন্ন সময় ৫৮০টি কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। সব কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ও এ ভবনে থাকার কথা। বাস্তবে এ ভবনে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব নেই।

সরেজমিনে দেখা গেল, ভবনটির নিচতলায় আছে এ বি টিম্বার্স, শ্যামলী কাঠঘর, সনজিতা টিম্বার ট্রেডার্সসহ বেশ কয়েকটি কাঠের ব্যবসায়ীর কার্যালয়। ছোট ছোট কক্ষ একেকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এ ছাড়া ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের একটি ওয়ার্কশপ আছে। সেখানে ঢুঁ মারতেই দেখা গেল, লেদ মেশিনে গাড়ির কলকবজা নিয়ে কাজ চলছে। আর দোতলাটি কাঠের গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তৃতীয়তলায় আছে কয়েকটি ল ফার্ম ও পরামর্শক সেবা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে শেখ মাহিমা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, এনএইচ কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, হেলাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কার্যালয়। সবার সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘এখানে জয়েন্ট স্টকের সকল কাজ করা হয়’। মূলত এসব পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই ওই সব কোম্পানি মালিকদের নিবন্ধন নিতে সহায়তা করেছে। আর চারতলায় এমএইচ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের ওয়্যারহাউস। প্রতিষ্ঠানটি খেলনা, বোতল, ফিডারসহ শিশুদের সামগ্রী আমদানি করে থাকে।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর দেশের সব কোম্পানির নিবন্ধন দেয়, যা আরজেএসসি নামেই বেশি পরিচিত। এই পরিদপ্তর ১, কারওয়ান বাজার ঠিকানায় অবস্থিত। তাজ ম্যানশন থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরেই পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়।

সরেজমিনে আরেকটি ভবন

তাজ ম্যানশনের মতো কারওয়ান বাজারে এমন আরেকটি ভবনের সন্ধান মিলেছে। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের পাশের ভবন শাহ আলী টাওয়ার। এ ভবনের ঠিকানা হলো ৩৩, কারওয়ান বাজার। দুই ভবনের মধ্যে শুধু একটি সরু সড়ক। ১৪ তলা শাহ আলী ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে মোট ৮১২টি কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে জানা গেছে, এ ভবনে বড়জোর ৬০ থেকে ৬৫টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় আছে। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আরজেএসসিতে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিতে সহায়তা করেছে। বাকিগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিটি তলায় ছয় থেকে সাতটি প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট কার্যালয়।

* কারওয়ান বাজারের তাজ ম্যানশনের ঠিকানায় ৫৮০টি কোম্পানি নিবন্ধিত * শাহ আলী টাওয়ারে ৮১২টি কোম্পানি * ঋণ পেতে এসব কোম্পানি গঠন

শাহ আলী টাওয়ারে অবস্থিত সাইফুল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় কাজের সুবিধার জন্য ক্লায়েন্ট আইনি পরামর্শকের ঠিকানা ব্যবহার থাকে। আবেদনপত্রের সঙ্গে নানা ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই এসব কাগজপত্র জোগাড় করে দেয়। তবে বিষয়টি ঠিক নয় বলে তিনি মেনে নেন।

কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আরজেএসসি কার্যালয়ের আশপাশের প্রায় প্রতিটি ভবনেই কোম্পানি নিবন্ধন নিতে সহায়তা করা হয় এমন ধরনের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি।

একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। একই ঠিকানা ব্যবহার করে এত কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে ওই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব। শিগগিরই ওই সব ঠিকানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখব।’ তিনি জানান, সাধারণত কাগজপত্র ঠিক থাকলেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত কোম্পানির ঠিকানায় সরেজমিনে দেখেশুনে নিবন্ধন দেওয়া হয় না।

এনবিআরের অনুসন্ধান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানি প্রতিষ্ঠার এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। আরজেএসসি থেকে কত কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে; তাদের মধ্যে কতটি কোম্পানি কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিয়েছে, কত কোম্পানি রিটার্ন দেয়—এসব বের করতে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট (সিআইসি) করপোরেট কমপ্লায়েন্স টাস্কফোর্স গঠন করে। এক বছর ধরে এ টাস্কফোর্স এ নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

এনবিআরের সিআইসির মহাপরিচালক আলমগীর হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, একই ঠিকানা ব্যবহার করে বহু কোম্পানি গঠনের চিত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু টিআইএন নেয়নি। ব্যবসা চালু থাকুক আর না–ই থাকুক আয়কর আইন অনুযায়ী এসব কোম্পানিকে টিআইএন নিতে হবে, বছর শেষে রিটার্নও দিতে হবে। এখন ওই সব কোম্পানিকে খুঁজে খুঁজে টিআইএন নিতে বাধ্য করা হবে। তিনি আরও জানান, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর পরিচালনায় আছে এমন কোম্পানির বাইরেও কাগুজে কোম্পানি গঠন করে। মূলত ঋণ পেতেই এসব কোম্পানি গঠন করার অভিযোগ আছে।

কোম্পানিসমূহকে করজালে আনতে গত বছরের আগস্ট মাসে এনবিআরের সিআইসির পরিচালক শব্বির আহমদের নেতৃত্বে করপোরেট কমপ্লায়েন্স টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হলেও কোন কোন কোম্পানি কর দেয় না, তা খুঁজে বের করার কাজে নামেন টাস্কফোর্স সদস্যরা। এক বছর ধরে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ও এনবিআরের মাঠপর্যায়ের কর সার্কেল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন কর গোয়েন্দারা। এ টাস্কফোর্স আরজেএসসির তথ্য ব্যবহার করে দেখেছে, কারওয়ান বাজারের ওই দুটি ঠিকানা ব্যবহার করে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো টিআইএন নেয়নি। কোনো করও দেয়নি। বেশির ভাগ নামমাত্র কোম্পানি। ওই সব কোম্পানির পরিচালক কারা, তা খুঁজে বের করে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেওয়ার পর হাজার হাজার কোম্পানি এনবিআর থেকে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও ব্যবসায় শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) নেয় না। কর ফাঁকি দেওয়াই এসব কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য। ফলে রাজস্ব ব্যবস্থায় এসব কোম্পানি অস্তিত্বহীন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। আমদানির শর্ত পূরণ করতে কিছু কোম্পানি টিআইএন নিলেও বছর শেষে রিটার্ন দেয় না।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আইনি সহায়তা দেয় এমন কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান নিজেদের ঠিকানা ব্যবহার করে আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিতে সহায়তা করে। আবার ওই আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানই ওই সব কোম্পানিকে কীভাবে কর ফাঁকি দেওয়া যাবে, সেই বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে থাকে। এটি একটি চক্র হিসেবে কাজ করছে। এসব আইনি সহায়তা দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। আর আরজেএসসি কিংবা এনবিআরের উচিত নিবন্ধন দেওয়ার পর সরেজমিনে কোম্পানির অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিশ্চিত করা। ঠিকানা অনুযায়ী কোম্পানির অফিস না থাকলে নিবন্ধন বাতিল করা উচিত।