উৎপাদন অঞ্চলেই লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম 

ঈদের আগে হিমাগারে এক কেজি আলুর দাম ছিল ১০ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকা।

ফাইল ছবি

উৎপাদন এলাকাখ্যাত বগুড়া অঞ্চলেই তিন সপ্তাহের ব্যবধানে হিমাগার পর্যায়ে সব ধরনের আলুর পাইকারি দাম দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়েছে। যেমন ঈদের আগে হিমাগারে প্রতি কেজি অ্যাসটরিক–গ্র্যানুলা (সাদা) ও কার্ডিনাল (লাল) জাতের আলু ১০ টাকা এবং দেশি ছোট বা পাকড়ি জাতের আলু প্রতি কেজি ১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিন সপ্তাহ পরে এসে গত বৃহস্পতিবার হিমাগারে প্রতি কেজি অ্যাসটরিক, গ্র্যানুলা ও ডায়মন্ড জাতের আলু বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকায়। আর দেশি পাকড়ি আলুর কেজিপ্রতি দাম উঠেছে ৩৫ টাকা।

সেসব আলু আবার পাইকারদের কাছ থেকে হাতবদলের পর খুচরা পর্যায়ে এসে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়। বগুড়া শহরে গত বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি ছোট বা পাকড়ি আলু ৪৫ টাকা ও কার্ডিনাল বা লাল আলু ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কার্ডিনাল আলু আবার ডায়মন্ড আলু নামেও পরিচিত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের পর বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় গত উৎপাদন মৌসুমে ৯৪ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আলু উৎপাদিত হয়েছে ২১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন। সংরক্ষণে জটিলতা ও খরচের কারণে উৎপাদক পর্যায়ে অর্থাৎ কৃষকেরা ভরা মৌসুমে অনেকটা কম দামে আলু বিক্রি করে দেন। সেই আলুর মধ্যে দুই জেলার ৫৬টি হিমাগারে ৫ লাখ ৫ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন সংরক্ষণ করেছেন ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা। হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে গড়ে ৬ টাকা খরচ পড়ে।

 দুই জেলায় হিমাগার পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার রেকর্ড পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ছে আলুর দাম। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন জাতভেদে প্রতি বস্তা আলুতে (৬০ কেজি) ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা হচ্ছে ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের। এ কারণে সংরক্ষণ মৌসুম শুরু হতে না হতেই  হিমাগার থেকে আলু বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে। হিমাগারমালিকেরা জানান, এই এলাকার ৫৬টি হিমাগার থেকে আগের বছরগুলোয় এই সময়ে কোনো আলু বিক্রি হয়নি। কিন্তু এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আলু ইতিমধ্যে হিমাগার থেকে বের হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই জেলায় গত উৎপাদন মৌসুমে ৫৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ১২ লাখ ২৫ হাজার ২০০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার ৩৭টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন আলু। আর জয়পুরহাটে ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার ১৯টি হিমাগারে ১ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে।

হিমাগারে আলুর দাম বাড়লেও কৃষকের তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ, উৎপাদন মৌসুমেই কৃষকেরা সিংহভাগ আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই এখন হঠাৎ আলুর বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
রাহেলা পারভীন, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জয়পুরহাট   

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুরিয়া এলাকার হিমাদ্রি কোল্ডস্টোরেজ, বলরামপুর শাহ সুলতান হিমাগার, মোকামতলা আর অ্যান্ড আর কোল্ডস্টোরেজ, কালাই উপজেলার পুনট কোল্ডস্টোরেজ ও আরবি স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিমাগারে রাখা প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) অ্যাসটরিক বা সাদা জাতের আলু ১ হাজার ৪৫০ টাকা, দেশি ছোট বা পাকড়ি আলু ২ হাজার ১০০ টাকা এবং ডায়মন্ড (কার্ডিনাল) জাতের আলু ১ হাজার ৬০০ টাকা দামে এখন বিক্রি হচ্ছে। বগুড়া ও জয়পুরহাট অঞ্চলের হিমাগারগুলোতে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তা আলুতে গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দাম বেড়েছে। 

বগুড়ার মোকামতলার আর অ্যান্ড আর কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজার রহমান প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের হিমাগারে এবার ১ লাখ ৬৬ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত বছর সংরক্ষণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার বস্তা। অন্যান্য বছর এই সময়ে ১ শতাংশ আলুও হিমাগার থেকে বের হতো না। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার হিমাগার থেকে আলু বিক্রির হিড়িক পড়েছে। 

 জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায়ও আলুর বাজারমূল্যে চাঙাভাব দেখা গেছে। সাধারণত বন্যা হলে আলুর দাম চড়া হয়। এবার দেশে খরা চলছে। অথচ আলুর দাম চড়া—এ কথা উল্লেখ করে পুনট কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার পাল বলেন, খরায় সবজি খেত নষ্ট হয়েছে। বাজারে সবজি সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। এ কারণে আলুর দামে প্রভাব পড়েছে।

বগুড়ার কিচক এলাকার আলু ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর হিমাগারে পাঁচ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করে ১৫ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিলাম। এবার বাজার চাঙা। বর্তমান বাজারদরে পাঁচ হাজার বস্তা আলুতে এবার ২৭ লাখ টাকা লাভ হওয়ার কথা।’

জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, হিমাগারে আলুর দাম বাড়লেও কৃষকের তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ, উৎপাদন মৌসুমেই কৃষকেরা সিংহভাগ আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই এখন হঠাৎ করে আলুর বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। হিমাগারে রাখা আলু যৌক্তিক দামে বিক্রি হওয়া উচিত।

এদিকে হিমাগারে আলুর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। গতকাল বগুড়ার ফতেহ আলী বাজারে প্রতি কেজি দেশি পাকড়ি জাতের আলু ৪৫ টাকা এবং কার্ডিনাল বা লাল আলু ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। 

হঠাৎ আলুর দাম বাড়ছে কেন, জানতে চাইলে বগুড়ার মহাস্থানহাটের কাঁচা-পাকা মাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, মৌসুমে মহাস্থানহাটে গড়ে ১০০ ট্রাক সবজি বেচাবিক্রি হয়। এ বছর গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড খরায় পুড়েছে খেত। এতে সবজির সববরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সে জন্য হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। 

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গত মৌসুমে উৎপাদিত আলুর মধ্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন রপ্তানি হয়েছে। উৎপাদন ঘাটতির কারণে এবার হিমাগারে তুলনামূলক কম আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন সবজি উৎপাদনের মৌসুম না। তাই বাজারে সবজির সরবরাহ কিছুটা কমেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে আলুর দাম আবার কমে আসবে।