বছরে হাঁসের উৎপাদন সাড়ে ৬ কোটির বেশি, বাজার দ্রুত বাড়ছে

দেশের বাজারে হাঁসের মাংসের পাশাপাশি এর ডিমের চাহিদাও বাড়ছে। তবে মাংস রপ্তানিতে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।

একসময় শহরে হাঁসের মাংসের বেচাকেনা তেমন চোখে পড়ত না। হাঁসের মাংস ও ডিম দুটোরই দেখা মিলত শুধু গ্রামে। কিন্তু গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। শীতের মৌসুম আসতেই শহরের বাসাবাড়ি তো বটেই, ভাতের ছোট হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁয় হাঁসের মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। কখনো কখনো শীত উদ্‌যাপনে পিঠাপুলি আয়োজনেও অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ‘হাঁস পার্টি’। সব মিলিয়ে দেশে দিন দিন হাঁসের মাংসের বাজার দ্রুত বাড়ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে হাঁসের সংখ্যা প্রতিবছরই বেড়েছে। ২০১৩–১৪ অর্থবছরে দেশে হাঁস উৎপাদন হয়েছিল ৪ কোটি ৮৯ লাখ, যা সর্বশেষ ২০২২–২৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৬০ লাখে। সেই হিসাবে ১০ বছরে হাঁস উৎপাদন ১ কোটি ৭১ লাখ বা ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে হাঁস উৎপাদন বেশি হয় দেশের হাওরাঞ্চলে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাঞ্চলেও চাষ বাড়ছে।

শীত মৌসুমে হাঁস বেচাকেনা অন্তত পাঁচ গুণ বাড়ে। ঢাকায় এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক করে হাঁস আসছে। শীত বাড়লে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। ব্যবসাটা মৌসুমি হলেও বছরের অন্য সময়েও হাঁস মোটামুটি বিক্রি হয়।
মো. বসির উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা উত্তর সিটি হাঁস-মুরগি আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি   

উৎপাদন বৃদ্ধিতে শহরকেন্দ্রিক মাংসের ব্যবসা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র পণ্ডিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাঁস পালনের জন্য হাওর খুব উপযোগী পরিবেশ। কারণ, প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাবার পাওয়ায় চাষাবাদ লাভজনক। ফলে অনেক হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। এতে বাণিজ্যিক চাষাবাদ সহজ হয়েছে। অনেকে এ ব্যবসায় ঝুঁকছেন। দুই বছরে কিশোরগঞ্জ জেলায় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। 

সরকারি হিসাবে, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে যত হাঁস উৎপাদিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির দাম ন্যূনতম ৫০০ টাকা ধরে হিসাব করলে বছরে হাঁসের বাজার দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হাঁসের মাংস ও ডিমের বাজারে দৃশ্যত বেশ বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। তাতে সরকারি হিসাবের চেয়েও হাঁসের বাজার আরও বড় বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে হাঁসের বাণিজ্যিক খামার আছে ১০ হাজারের বেশি। হাঁসের ব্যবসা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ডিমের বাজারও বড় হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শহরে হাঁসের মাংস বিক্রির প্রবণতা শুরু হয়েছে মূলত ২০১৫ সালের দিকে। সারা বছর কমবেশি বিক্রি হলেও, বেশি চাহিদা থাকে শীত মৌসুমে। এ সময় বেচাকেনা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। ঘরোয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শীতের পিঠার সঙ্গে খেতেও হাঁসের মাংসের চাহিদা আছে। চুইঝাল দিয়ে রান্না করা হাঁসের মাংসও খেতে পছন্দ করেন অনেকে।  

রাজধানীর পূর্বাচল নীলা মার্কেট–সংলগ্ন মূছা মীর জামাই–বউ হোটেলের স্বত্বাধিকারী মো. মুছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বছর হাঁসের মাংস বিক্রি করি। তবে শীত আসলে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজির মতো মাংস বিক্রি করতে পারি। বছরের অন্যান্য সময় যা এর অর্ধেকের কম হয়। প্রতি বাটি হাঁসের মাংসের দাম রাখি ২০০ টাকা।’  

বাণিজ্যিকভাবে পালন করা হাঁসের বড় অংশ ‘পাতিহাঁস’। এই হাঁসের আবার নানা ধরন আছে। তবে বাজারে পাতিহাঁসের পাশাপাশি রাজহাঁস ও চিনাহাঁসের চাহিদাও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে শীতকাল এলে সব জাতের হাঁসই বিক্রি হয়। হোটেল–রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাঁসের মাংসের বাজারটা চাঙা থাকে আড়াই থেকে তিন মাস। বড় বেচাকেনা শুরু হয় নভেম্বরের মাঝামাঝি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মৌসুম শেষ হয়ে আসে।

রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে গত বুধবার কাপ্তানবাজারে হাঁস কিনতে যান বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ হুসাইফি। সেখানে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শীত এলে বাসার সবাই গরুর মাংসের চেয়েও হাঁসের মাংস বেশি পছন্দ করে। তাতে এই দুই–তিন মাস নিয়মিতভাবে হাঁস কিনতে হয়। 

রাজধানীতে মোটাদাগে তিনটি স্থানে হাঁসের পাইকারি বেচাকেনা হয়— মোহাম্মদপুর–বছিলা বেড়িবাঁধ–সংলগ্ন সাদেক খান মুরগির বাজার, কাপ্তানবাজার আড়ত ও এফডিসি–সংলগ্ন ঢাকা মহানগর হাঁস-মুরগির আড়ত। এর মধ্যে শীত মৌসুমে প্রতিদিন সাদেক খান মুরগির বাজারে বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার, কাপ্তানবাজারে আড়াই থেকে তিন হাজার এবং এফডিসি–সংলগ্ন ঢাকা মহানগর হাঁস-মুরগির আড়তে চার থেকে পাঁচ হাজার হাঁস বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি হাঁস–মুরগি আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. বসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শীত মৌসুমে হাঁস বেচাকেনা অন্তত পাঁচ গুণ বাড়ে। ঢাকায় এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক করে হাঁস আসছে। শীত বাড়লে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। ব্যবসাটা মৌসুমি হলেও বছরের অন্য সময়েও হাঁস মোটামুটি বিক্রি হয়।

কাপ্তানবাজারের বিক্রেতা আবু তাহের জানান, ‘এবার পাইকারি বাজারে পাতিহাঁসের পাশাপাশি রাজহাঁস ও চিনাহাঁসের বেচাকেনা ভালো চলছে। বছরের অন্য সময়ে হাঁস–মুরগি দুটোই বিক্রি করি। তবে শীত মৌসুম শুরু হলে মুরগি বন্ধ রেখে শুধু হাঁস বিক্রি করি। হাঁসের নানা জাত থাকায় ক্রেতাও ভালো পাই। অধিকাংশ হাঁস আসে হাওর ও উত্তরাঞ্চল থেকে।’  

দরদাম যেমন

ঢাকার বাজারে এখন দেড় কেজি ওজনের প্রতিটি জীবন্ত পাতিহাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এক কেজির বেশি ওজনের পাতিহাঁসের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। সুপারশপগুলো ড্রেসিং করা প্রতি কেজি পাতিহাঁসের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা নেয়। আর জীবন্ত রাজহাঁস ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা ও চিনাহাঁস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে দাম কিছু কমবেশিও হতে পারে। 

বিক্রেতারা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার হাঁসের দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। সুপারশপ ও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ড্রেসিং করা ও রান্নার উপযোগী করে রাখা হাঁস পাওয়া যায়। বাজার থেকেও হাঁসের পালক ছাড়ানোর সুযোগ থাকে। তাতে আকারভেদে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ১০০ টাকার মতো।

দিনাজপুরে বাণিজ্যিকভাবে হাঁস পালনের সঙ্গে যুক্ত আহাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতকালে মাংসের বাড়তি চাহিদা থাকায় হাঁস পালন বেশ লাভজনক। হাঁসের ডিমের দামও ভালো। ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে গেছে, এমন হাঁস বিক্রি করে ভালো দাম পাওয়া যায়।’

এদিকে দেশে হাঁসের বাজার বাড়লেও রপ্তানিতে তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানান বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ এফ এম আসিফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাঁসের মাংস রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। চাহিদাও মৌসুমি। তাই রপ্তানি সম্ভাবনার বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।