সঞ্চয়পত্রের মুনাফার করসহ যেসব বিষয় থাকছে নতুন আয়কর আইনে

যা থাকছে নতুন আইনে
• নায়ক-নায়িকার আয়ে ১০% উৎসে কর
• বিদেশ ভ্রমণ করলে সম্পদের হিসাব দিতে হবে
• রপ্তানির নগদ সহায়তায় উৎসে কর
• কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা কমছে
• কাগজপত্র জমার সংখ্যাও কমছে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করলে কোনো কর দিতে হবে না। আপনি যখন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে যাবেন, তখন আপনার মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে রাখা হবে না।

নতুন আয়কর আইনের উৎসে করের ধারায় এ বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, মধ্যবিত্তকে সুরক্ষা দিতেই আইনের খসড়ায় এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আইনটি সংসদে পাস হলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ছোট সঞ্চয়কারীরা মুনাফার পুরো টাকাই হাতে পাবেন। নতুন আয়কর আইনের এই খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে।

বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রে ভেদে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কাটার বিধান আছে। বছর দুই আগে প্রজ্ঞাপন জারি করে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে উৎসে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। নতুন আইনে এই সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

নতুন আয়কর আইনে আরও যা প্রস্তাব করা হয়েছে—

নায়ক-নায়িকার আয়ে ১০ শতাংশ উৎসে কর
সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপনে অভিনয় করার জন্য অভিনয়শিল্পীরা সম্মানী পান। মন্ত্রিসভার অনুমোদন করা নতুন আইনে নায়ক-নায়িকাদের সম্মানীর ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। এমনকি রেডিও-টিভিতে টক শো, অনুষ্ঠানের সম্মানীর ওপরও এই কর বসবে। প্রযোজক প্রতিষ্ঠান তাদের সম্মানী দেওয়ার সময় এই অর্থ কেটে রেখে বিল পরিশোধ করবে। তবে কারও সম্মানী ১০ হাজার টাকা কম হলে উৎসে কর কাটা হবে না।

অন্যান্য উৎসে কর

রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। সেখানে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর রাখা হবে বলে নতুন আইনে বিধান করা হয়েছে। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের সম্মানীর ওপর আনুমানিক সারা বছরের করের হিসাবে সম্মানী দেওয়ার সময় কর কেটে রাখা হবে। প্রতি মাসে সম্মানী দেওয়া হলে সারা বছরে কত কর হতে পারে, এর ওপর ভিত্তি করে উৎস করের টাকা কাটবে সরকার।

আরও পড়ুন

স্বেচ্ছাক্ষমতা কমবে কর কর্মকর্তাদের

নতুন আয়কর আইন সংসদে পাস হলে কর কর্মকর্তারা চাইলেই নিজের ইচ্ছেমতো কর বসাতে পারবেন না। কোনো করদাতার কর নথিতে অসংগতি বা কর ফাঁকি ধরা পড়লে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে গাণিতিক হিসাব করে করের পরিমাণ, জরিমানা ও সুদ ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া নতুন আইনে কর কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার সংখ্যাও কমবে। এখন তাদের গড়ে ২৯ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এই সংখ্যা ১২-তে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

বিদেশ ঘুরতে গেলে সম্পদের হিসাব বাধ্যতামূলক

বিদেশে ঘুরতে গেলেই আপনাকে বছর শেষে আপনার সব ধরনের সম্পদের তথ্য জানাতে হবে। শুধু চিকিত্সা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করলেই আয়কর রিটার্ন জমার সময় সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। নতুন আয়কর আইনে এই শর্ত দেওয়া হয়েছে।

আপনার করযোগ্য আয় থাকুক কিংবা না থাকুক, দেশের সীমানা পেরোলেই আপনার ফ্ল্যাট-জমি, আসবাব, ব্যাংক ব্যালান্সসহ যাবতীয় সম্পদের তথ্য জানানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কর শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ থাকায় এখন আর কেউ বিদেশ ভ্রমণ করে তা লুকাতে পারবেন না।

হঠাৎ আয়কর আইন পাসে তোড়জোড়

২০১৭ সালের দিকে নতুন আয়কর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু প্রথম তিন বছরে আইনের খসড়া প্রস্তুত করাই সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনা ছিল ২০২১ সালে আইনটি চালু করার। কিন্তু আইনের খসড়া প্রণয়ন, ব্যবসায়ীসহ অংশীজনদের মতামত নেওয়া, মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন, জাতীয় সংসদে পাসের জন্য পাঠানো—এসব ধাপের বেশির ভাগই শেষ করতে পারেনি কর বিভাগ। মাত্র কয়েক মাস আইনের খসড়াটি মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়।

সরকার চলমান সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার সহায়তা চাইছে। আইএমএফের প্রাথমিক একটি মিশন দুই মাস আগে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছিল। তখন রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে রাজস্ব খাত সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে যুগোপযোগী একটি আয়কর আইন করার পরামর্শ দেয় আইএমএফ। আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নতুন আয়কর আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

এখন আইনটি জাতীয় সংসদে পাসের জন্য বিল আকারে পাঠানো হবে। এর আগে আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে নতুন ভ্যাট আইন করেছিল এনবিআর। এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইনে এখন অনেক কাজ করার বাকি আছে। কর-জিডিপি বৃদ্ধি করতে যেসব সমস্যা ছিল, এর সমাধান এই আইনে নেই। ব্যবসায়ীসহ অংশীদের সঙ্গে আইনটির খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার কথাও শুনিনি।’

আমিনুর রহমান আরও বলেন, ‘ভ্যাট আইন থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। এত তাড়াহুড়া করার দরকার ছিল না।’