উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় দেশি–বিদেশি উদ্যোক্তারা

১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠছে এই শিল্পনগর। ১৩টি শিল্পের কারখানা নির্মাণ শেষ পর্যায়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে অনেক কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে তোলা
ছবি: সৌরভ দাশ

কোথাও টাঙানো হয়েছে কারখানার সাইনবোর্ড। কোথাও বালুমাটি দিয়ে চলছে নিচু জমি ভরাটের কাজ। বিশাল এলাকায় নানা প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে নির্মাণকাজের বিকট শব্দ। ধীরে ধীরে ঢেকে যাওয়া বালুচরে মাথা তুলতে শুরু করেছে কারখানার ভবন। উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও গুছিয়ে এনেছে কয়েকটি কারখানা। এসব কারখানায় এখন শুধু উৎপাদন শুরুর অপেক্ষা।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে গত সপ্তাহে সরেজমিন ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, করোনা না হলে এ বছরই উৎপাদন শুরু হয়ে যেত শিল্পনগরের অন্তত পাঁচটি কারখানায়। করোনার কারণে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা না আসায় এসব কারখানা প্রায় প্রস্তুত হলেও চালু করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে অনেক কারখানার নির্মাণকাজ ব্যাহত হয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোনের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর অন্তত চার-পাঁচটি শিল্পকারখানা উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা উদ্যোক্তাদের কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। এরপরও এই শিল্পনগরে ১৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই শিল্পনগর। বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা ঘিরে এই শিল্পনগরের আয়তন হবে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। এর ৪১ শতাংশ বা ১৪ হাজার একরে থাকবে শুধু শিল্পকারখানা। বাকি ৫৯ শতাংশ এলাকার মধ্যে খোলা জায়গা, বনায়ন, বন্দর সুবিধা, আবাসন, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও বিনোদনকেন্দ্র থাকবে।

অপেক্ষা বাড়ছে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত শেখ হাসিনা সরণি পেরিয়ে গেলেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। নতুন নির্মিত পিচঢালাই সড়ক ধরে এখনই সরাসরি শিল্পনগরের উপকূলীয় প্রতিরক্ষা বাঁধ পর্যন্ত যাওয়া যায়। শিল্পনগরের বেজা প্রশাসনিক ভবনের অদূরে ১০ একর জায়গায় ২৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে দেড় বছর আগে নির্মাণকাজ শেষ হয় চীনের জুজু জিনইয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার। করোনা মহামারি শুরুর পর উদ্যোক্তারা চীনে ফেরত যান। এরপর আর ফিরে আসেননি। কারখানাটি এখন পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীরা।

এই কারখানার অদূরে ইস্পাত পাত প্রক্রিয়াকরণের ‘নিপ্পন অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কারখানার কাজ শেষ হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস আগে। জাপানের নিপ্পন স্টিল ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কারখানা গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ। যৌথ উদ্যোগ ছাড়াও ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টস লিমিটেডের আরেকটি কারখানার কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রায় ১০০ একর জমিতে ছয় কোটি ডলার ব্যয়ে এখানে এই দুটি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।

ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর এপ্রিল-মে মাসে যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত কারখানার উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। করোনার কারণে বিদেশিরা আসতে না পারায় উৎপাদন শুরু করতে দেরি হচ্ছে। তবে এ বছর শেষে ম্যাকডোনাল্ড স্টিলের উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য আছে। পুরোদমে চালু হবে আগামী বছর।

বেজা প্রশাসনিক ভবনের কিছুটা সামনে পুরোদমে কাজ চলছে ভারতীয় কোম্পানি এশিয়ান পেইন্টসের। কাঁচামাল ও রং উৎপাদনের এই কারখানার উৎপাদন শুরুর কথা ছিল গত জুনে। করোনার কারণে এই কারখানাটিরও উৎপাদন পিছিয়ে গেছে। সেখানে ঘুরে দেখা যায়, ২০ একর জায়গায় এই কারখানার কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। ১৫০ কেভি বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ারজেনসহ পাঁচটি কারখানার এ বছর উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়নি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ কমে যাওয়ায় এখন অন্য কারখানাগুলোর কাজ জোরেশোরে চলছে। প্রায় ২০ একর জায়গায় ১৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে গড়ে তোলা হচ্ছে মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানা। এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশ পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। আরও কয়েকটি কারখানা নির্মাণের কাজ এখন দৃশ্যমান। শিল্পনগর ঘুরে দেখা যায়, বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এসবিজি অর্থনৈতিক অঞ্চলে এখনো কোনো কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। শুধু মাটি ভরাট করে উঁচু করা হয়েছে।

বিনিয়োগ বাড়ছে, অপেক্ষায় উদ্যোক্তারা

দেশের অন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগ আসছে বেশি। এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। এর ৭১ শতাংশ বা ২০ বিলিয়ন ডলার এসেছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে। অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ জানায়, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এ পর্যন্ত ১২২টি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ হাজার একরের জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অপেক্ষায় আছে ৩১টি প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার একর জমিতে বিনিয়োগ আসছে।

মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ৩৪ হাজার একর জমির মধ্যে ইতিমধ্যে বেজার হাতে ২১ হাজার একর জমি রয়েছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হবে বলে বেজা জানিয়েছে। বিনিয়োগ এলেও উদ্যোক্তারা এখন লজিস্টিকস সুবিধার অপেক্ষায় আছেন। শিল্পকারখানার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও যোগাযোগব্যবস্থা। বেজা গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করছে। নির্মাণাধীন শিল্পকারখানার আশপাশে রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়েছে। তবে পানির সংস্থান এখনো হয়নি।

শিল্পনগরে প্রতিদিন ১১২ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হবে। শুরুতে কারখানার সংখ্যা কম থাকায় অবশ্য পানির চাহিদা কম থাকবে। পানির চাহিদা পূরণে যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো চালু হতে সময় লাগবে। এর আগে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করতে হবে।

৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন

২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। এই ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে বাড়তি ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি প্রত্যাশা করছে সরকার। এর আওতায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর গড়ে তোলা হচ্ছে।

শুরুতে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নামে এর উদ্বোধন হয় ২০১৬ সালে। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে আবেদন নেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে এখন শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ জন্য ২০১৮ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শিল্পনগরের নাম দেওয়া হয়। শিল্পনগরে শিল্পকারখানার পাশাপাশি আবাসন, বিনোদন, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের সুবিধা থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাজ চলছে ২৮টির। সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের আয়তন হবে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর, যা মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া বাস্তবায়নাধীন ২৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের আয়তনের চেয়ে বেশি।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫০ বছর মেয়াদে বেজা অনুন্নত ও উন্নত জমি ইজারা দিচ্ছে। আর শিল্পকারখানার জন্য সব সুবিধা করে দিচ্ছে বেজা। সাগরের পানি থেকে শিল্পনগরকে রক্ষার জন্য ২৩ কিলোমিটার উঁচু বাঁধ বা সুপার ডাইক নির্মাণ করে দিচ্ছে বেজা।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে উন্নয়নকাজের গতি আরও বাড়াতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও বন্দর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সুবিধা পুরোপুরি না থাকলে কারখানা চালু রাখা যাবে না। এখন যেহেতু করোনার প্রকোপ কমেছে, তাই এসব কাজ দ্রুত শেষ করা উচিত।