এবারও দূষণের শঙ্কা সাভারে

কোরবানি উপলক্ষে সাভারের চামড়া শিল্পনগরের বর্জ্য পরিশোধনাগার প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে কোরবানির সময় ট্যানারিগুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা অপসারণের সক্ষমতা নেই সিইটিপির।
ছবি প্রথম আলো

সাভারের চামড়া শিল্পনগর ঘিরে এবারও দূষণের আশঙ্কা করছেন সেখানকার ট্যানারিশিল্প মালিকেরা। তাঁরা বলছেন, কোরবানির সময়ে ট্যানারিগুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা অপসারণের সক্ষমতা নেই কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি)। এ কারণে এবারও দূষণের শঙ্কায় রয়েছেন শিল্পমালিকেরা।

বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকার দূষণ কমাতে পাঁচ বছর আগে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়া পরিশোধন কারখানা বা ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়া শিল্পনগরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও পিছু ছাড়েনি ট্যানারি বর্জ্যে পরিবেশ দূষণের ঘটনা। প্রতিবছর ঈদুল আজহা বা কোরবানির মৌসুমে ওই এলাকায় দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

তবে শিল্পনগরটির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, দূষণ রোধে এবার তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে ট্যানারির মালিক ও পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এ বছরও দূষণের শিকার হবে শিল্পনগরের পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীসহ আশপাশের এলাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। এ ছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধের পাশে, খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হতো। এ সমস্যা সমাধানে শিল্প মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে তৈরি করে চামড়া শিল্পনগর। বর্তমানে শিল্পনগরে উৎপাদনে আছে প্রায় ১৪০টি ট্যানারি।

সাভার চামড়া শিল্পনগরের ট্যানারিগুলোতে উৎপাদিত তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলার কথা। এ জন্য প্রায় ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সিইটিপি করা হয়েছে। আর সিইটিপির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি। কোম্পানিটি তরল বর্জ্য পরিশোধনের পাশাপাশি কঠিন বর্জ্যও সিইটিপির পার্শ্ববর্তী ডাম্পিং ইয়ার্ড বা আস্তাকুঁড়ে ফেলে।

গত মঙ্গলবার সাভার চামড়া শিল্পনগরে গিয়ে দেখা যায়, ডাম্পিং ইয়ার্ডটি একরকম পূর্ণ অবস্থায় আছে। এটির এক পাশের দেয়াল ভাঙা। অতীতে ইয়ার্ড ভেঙে নদীতে বর্জ্য পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া পুরো এলাকায় পচা–উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কোরবানির বাড়তি চাপ সামাল দিতে ইয়ার্ডের পাশে একটি বড় গর্ত খনন করা হয়েছে।

এ ছাড়া ট্যানারিগুলোর তরল বর্জ্য ভূ–অভ্যন্তরের নালার মধ্য দিয়ে সিইটিপিতে গিয়ে পরিশোধিত হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, সিইটিপির প্ল্যান্টগুলো কোরবানির বর্জ্য পরিশোধনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ সিইটিপির ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। তবে কোরবানির মৌসুমে এ শিল্পনগরে গড়ে ৩০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এ কারণে কোরবানির সময় বাড়তি বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

চামড়া শিল্পনগরীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা মহসিন উদ্দিন বলেন, ঈদের পর কারখানার কাজ বেড়ে গেলে নদীতে সরাসরি ময়লাপানি ফেলা হয়। এমনিতে সারা বছর কমবেশি দুর্গন্ধ থাকে। কিন্তু কোরবানির পর এ দুর্গন্ধ অনেক বেড়ে যায়।

ট্যানারির মালিকেরা জানিয়েছেন, এ বছর কোরবানিতে চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ পাঁচ থেকে সাত শতাংশ বাড়তে পারে। তাই স্বাভাবিকভাবে বর্জ্যের পরিমাণও বেশি হতে পারে। বাড়তি এই চাপ সামাল দিতে না পারলে এবারও দূষণের ঘটনা ঘটবে। তবে সিইটিপি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কোরবানির ঈদে ট্যানারির তরল বর্জ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে তারা।

জানতে চাইলে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও সমতা লেদারসের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ বছরও কোরবানির মৌসুমে ট্যানারি বর্জ্য থেকে দূষণের শঙ্কা আছে। সাভারের ট্যানারিতে প্রায় সব কাজই তড়িঘড়ি করে হয়েছে। এ জন্য এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর নয়

পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চামড়া শিল্পনগরের সিইটিপি এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। সর্বশেষ গত ৬ জুন বর্জ্যের নমুনা পরীক্ষা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাতে দেখা গেছে, টোটাল ডিজলভড সলিড (টিডিএস) ও টোটাল ক্রোমিয়াম—এ দুই মানদণ্ডে সিইটিপি এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ের উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ট্যানারিশিল্প এলাকা পর্যবেক্ষণ করছি। বর্তমানে সিইটিপির কার্যক্ষমতা ৭০ শতাংশ। এ কার্যক্ষমতা শতভাগে উন্নীত করতে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। কোরবানির সময় শিল্প এলাকার সার্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য পাঁচ সদস্যের একটা বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, এ বছর আগের মতো দূষণ হবে না।’

বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে মিটার স্থাপন

চলতি মৌসুমে তরল বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ কমাতে ট্যানারিগুলোতে ওয়াটার মিটার ও ফ্লো মিটার স্থাপন করেছে সিইটিপি কর্তৃপক্ষ। চলতি মাস থেকে পানির বিলও দিতে হবে কারখানাগুলোকে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ট্যানারির উৎপাদনক্ষমতা অনুসারে তরল বর্জ্য বণ্টনসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কোনো কারখানা তার চাহিদার চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করলে কিংবা নির্ধারিত পরিমাপের চেয়ে বেশি তরল বর্জ্য নির্গমন করলে তা চিহ্নিত করা যাবে।

বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন ট্যানারির মালিকেরাও। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত বলেন, যেহেতু পানির দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তাই ট্যানারি কারখানাগুলো খরচ কমাতে প্রয়োজনের বেশি পানি খরচ করবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টেস ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমরা এবার কোনোভাবেই সিইটিপির ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য উৎপাদিত হতে দেব না। ইতিমধ্যে এ নিয়ে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি।’ কঠিন বর্জ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা হিসাব করেই গর্ত খনন করেছি। আশা করছি, ওই স্থানে উৎপাদিত বর্জ্যের সংকুলান হয়ে যাবে।’

গত মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শনের সময় শিল্পনগরের সাধারণ নালা দিয়ে রাসায়নিক মিশ্রিত বিভিন্ন রঙের তরল সরাসরি ধলশ্বেরীতে পড়তে দেখা যায়। এ বিষয়ে মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘নালার ময়লা দূষিত কি না, তা না দেখে বলতে পারব না। এ রকম হওয়ার কথা নয়। সিইটিপিতে তরল বর্জ্য যাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা আছে।’