কমছে তাঁতি, কমছে তাঁতের সংখ্যাও

হস্তচালিত তাঁতে বেনারসি শাড়ি বুনছেন একজন কারিগর। গতকাল রাজধানীর মিরপুরের বেনারসিপল্লিতে
ছবি: আশরাফুল আলম

একসময় বিয়েতে কনের পোশাক মানেই ছিল বেনারসি শাড়ি। অভিজাত থেকে শুরু করে সামর্থ্যবান পরিবারে এ বেনারসির ছিল ব্যাপক কদর ও জনপ্রিয়তা। রাজধানীর মিরপুরের বেনারসিপল্লিতে বানানো হতো এসব শাড়ি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারতেও নিয়মিত রপ্তানি করা হতো এ দেশের তাঁতিদের বানানো বেনারসি।

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে বেনারসি তৈরির কারিগর তথা তাঁতি ও তাঁতের সংখ্যা। কারণ, তখন এ শাড়ি কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের ছিল না। আগের তুলনায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়েছে এখন। কিন্তু বেনারসির সেই সুদিন আর নেই। এখন রপ্তানি তো দূরে থাক, বেনারসিপল্লির দোকানগুলোতেই এখন যেসব শাড়ি বিক্রির জন্য রাখা হয় তার অর্ধেকের বেশি ভারতীয় শাড়ি। বেনারসির তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৩০ বছরে বেনারসিপল্লিতে তাঁতের সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের নথি অনুসারে, ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে ভারতের বেনারস থেকে তাঁতের শাড়ি বুননে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন বেশ কিছু মুসলিম মোহাজের পরিবার ঢাকায় আসে। তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে মালিটোলা, বেচারাম দেউড়ি, মৈশুণ্ডী, লালমোহন স্ট্রিটে কাতান বেনারসি শাড়ি তৈরি শুরু করে। ১৯৫০ সালের দিকে এসব মোহাজের প্রথমে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও পরে মিরপুরে এসে থিতু হন। পরে তাঁদের হাত ধরেই মিরপুরের ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে বেনারসিপল্লির গোড়াপত্তন হয়। পরে তাঁদের কাছ থেকে বিহারি মুসলিম ও বাঙালিরাও বেনারসি কাতান শাড়ি বানানোর কৌশল রপ্ত করেন। তাতে এই পল্লির আকার আরও বড় হয়।

যাত্রা শুরুর পর দুই দশকে বেশ ভালোই বিস্তৃত হয় বেনারসি শাড়ির বাণিজ্য। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাঁতিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। মিরপুরের এসব তাঁতি বাস করতেন সড়কের পাশে সরকারি জমিতে। ফলে বিভিন্ন সময়ে খাসজমি উদ্ধারের জন্য উচ্ছেদ করা হয় তাঁতিদের। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে তাঁতির সংখ্যা।

বেনারসি শাড়ি
ছবি: প্রথম আলো

১৯৯০ সালে তাঁত বোর্ডের করা এক জরিপ অনুসারে, ওই বছর মিরপুর ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে বেনারসি তাঁতি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৮১৫টি। আর তাঁতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার ৯২০। আর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা তাঁতশুমারির তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর এলাকায় বেনারসি তাঁতি পরিবারের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৯২। আর তাঁতের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৫। এর মধ্যে আবার অলস পড়ে আছে প্রায় ২২৮টি তাঁত। সেই হিসাবে, ২৮ বছরের ব্যবধানে তাঁতের সংখ্যা কমেছে ২ হাজার ৩২৩টি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁতি পরিবার ও তাঁতসংখ্যার পরিমাণ আরও কমেছে বলে দাবি স্থানীয় তাঁতি ও তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তাদের। তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বেনারসিপল্লি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

মাসে আড়াই কোটি টাকার শাড়ি বানান তাঁতিরা

বিয়ে, অনুষ্ঠানে ও নিয়মিত পড়া যায়, এমন বিভিন্ন ধরনের বেনারসি কাতান শাড়ি বানান মিরপুরের বেনারসিপল্লির তাঁতিরা। বর্তমানে সাধারণ পলিয়েস্টার সুতা দিয়ে কম দামি শাড়িই সবচেয়ে বেশি বানান তাঁরা। কারণ, সারা দেশে এসব শাড়ি বেশি চলে।

বেনারসিপল্লির ৫ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক বেনারসি তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবীবুর রহমান জানান, বর্তমানে বেনারসিপল্লিতে চার শতাধিক তাঁতি নিয়মিত শাড়ি বানান। প্রতি মাসে তাঁরা গড়ে ১ হাজার পিস সিল্ক সুতার ও আড়াই হাজার পিস পলিয়েস্টার সুতার শাড়ি তৈরি করেন। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার শাড়ি তৈরি হয়। আর বিয়েশাদির মৌসুমে চার কোটি টাকার সমমূল্যের শাড়ি তৈরি ও বিক্রি করা হয়।

পেশা ছাড়ার কারণ

তাঁতিরা জানান, মিরপুরে জমির দাম ও বাসাভাড়া অনেক বেড়েছে। ফলে ওই এলাকায় জমি কিনে বা বাসা ভাড়া নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তাঁতিরা। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানের ফলে অনেক তাঁতি অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বেনারসিপল্লি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর কেউ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছেন। তাঁতিরা জানান, আগে বেনারসিপল্লির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগর, সহকারী ও অন্যান্য কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি লোক যুক্ত ছিলেন। এখন প্রায় ৭৫ শতাংশ লোকই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

ভারতীয় শাড়ির দাপটে মার খাচ্ছেন তাঁতিরা

২০০০ সালের আগপর্যন্ত মিরপুর বেনারসিপল্লির ব্যবসা খুব জমজমাট ছিল। এরপর থেকে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ভারতের শাড়ির দাপটে মন্দা দেখা দেয় বেনারসির ব্যবসায়। মিরপুরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তাঁতি জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, ভারতের কারিগরেরা বৈদ্যুতিক তাঁতযন্ত্রে শাড়ি বানান। আর আমরা বানাই হাতে। এ জন্য ভারতের সঙ্গে সময় ও খরচে কুলিয়ে ওঠা যায় না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্রোকেড ধরনের বেনারসি শাড়ি হাতে তৈরিতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু বৈদ্যুতিক তাঁতযন্ত্রে এ ধরনের শাড়ি তৈরি হয় দুই দিনে। আবার উৎপাদন খরচও কম। তাই তাঁরা তুলনামূলক কম দামে এসব শাড়ি বিক্রি করতে পারেন। একেকটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের দাম প্রায় ১ কোটি টাকা। এ কারণে ভারতীয় শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না মিরপুরের তাঁতিরা।

দাম বেড়েছে কাঁচামালের

মিরপুরের তাঁতি মোহাম্মদ শফিউল্লাহ জানান, ২০০০ সালের দিকে প্রতি কেজি পিউর চায়না সিল্ক সুতা কিনতেন প্রায় ১ হাজার ১০০ টাকায়। এখন সেই সুতার দাম আট হাজার টাকা। করোনার কারণেও সুতার দাম বেড়েছে। ৪০০ গ্রাম সিল্ক সুতা দিয়ে একটি কাতান বেনারসি শাড়ি তৈরি করা যায়। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু এসব শাড়ির ক্রেতা কম। তাই পলিয়েস্টারজাতীয় সুতা দিয়ে কম দামে শাড়ি বানান তাঁতিরা। এসব শাড়ি বেনারসি কাতান নামে বিক্রি করে দোকানদারেরা।

পুনর্বাসিত হতে চান বেনারসির তাঁতিরা

মিরপুর এলাকায় বেনারসি তাঁত বুননের কাজের সুযোগ এখন সীমিত। তাই তাঁতিদের দাবি, তাঁদের অন্যত্র পুনর্বাসনের। কারণ, তাঁতের শব্দের কারণে অনেকে তাঁতিদের বাসা ভাড়া দিতে চান না। তাঁতিদের পুনর্বাসনের জন্য প্রায় তিন দশক আগে একটি প্রকল্প নিয়ে রাজধানীর ভাসানটেকে ৪০ একর জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই জায়গায় তাঁতিদের বাসস্থান ও কারখানা স্থাপনের জন্য ৯০৬টি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। ২০০৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাঝপথে তা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ভাসানটেকের প্রকল্পটি এখন বন্ধ আছে। তাঁতিদের পুনর্বাসনের জন্য মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায় শেখ হাসিনা তাঁতপল্লির নির্মাণকাজ চলছে।

শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি স্থাপন (১ম পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলী খান বলেন, বর্তমানে ৩০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলছে। এটা শেষ হলে পরবর্তী ধাপের কাজ শুরু হবে। আর ভাসানটেকে বেনারসিপল্লির তাঁতিদের পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা।