কারখানার ছাইও এখন মূল্যবান

বিলেট তৈরির কারখানাগুলো চুল্লির ধোঁয়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ছাই তৈরি করে রপ্তানি করছে। এতে বছরে পৌনে দুই কোটি ডলার আয় হয়।

কারখানার ধোঁয়া ছাইয়ে পরিণত করে একসময় ফেলে দেওয়া হতো। এই ধোঁয়াও যে মূল্যবান রপ্তানি পণ্য হতে পারে, তা তখন জানা ছিল না।
তবে কারখানায় দিন দিন ছাইয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা খোঁজখবর নিয়ে যখন জানতে পারেন যে এটিও বিশ্ববাজারে বেচাকেনা হয়। খবরটি জেনেই উদ্যোক্তারা ছাই রপ্তানির চেষ্টা করেন। বর্তমানে ইস্পাত কারখানাগুলো ছাই রপ্তানি করছে। এতে বছরে কোটি ডলারের মতো আয় হচ্ছে তাদের।

দেশে ধোঁয়া থেকে ছাই বের করে তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথটি প্রথম দেখায় চট্টগ্রামের ইস্পাত কারখানা বিএসআরএম। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিএসআরএম গ্রুপ এক দশক আগে ছাই বিনিয়োগ করে গ্রুপটি। ২০১২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি সীমিতভাবে ছাই রপ্তানি করে আসছে। এই তালিকায় পরবর্তীকালে আরও যুক্ত হয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত, কেএসআরএমের মতো বিলেট উৎপাদনকারী কারখানাগুলো। তবে বিএসআরএম ও জিপিএইচ ছাড়া বেশির ভাগ কারখানা সরাসরি রপ্তানি করে না। তাদের কাছ থেকে ছাই কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চীন, স্পেন, ভারত, কোরিয়া, তুরস্ক, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে ছাই রপ্তানি করে। কালি ও প্রিন্টারের কার্টিজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে এই ছাই ব্যবহার করা হয়।

কাস্টমস বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, জিংক অ্যাশ ও জিংক অক্সাইড নামে ছাই রপ্তানি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবমতে, এই দুটি নামে ছাই রপ্তানি করে সর্বশেষ ২০২০–২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি ডলারই ছিল ছাই। বাকি পণ্য হচ্ছে ঢেউটিন কারখানার উপজাত ‘জিংক ড্রস’।

রপ্তানিকারকেরা জানান, বিলেট কারখানার ধোঁয়া থেকে এই ছাই পাওয়া যায়। মূলত পুরোনো লোহার টুকরো গলিয়ে বিলেট তৈরির সময় চুল্লিতে ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। ওই ধোঁয়া যাতে বাতাসে মিশতে না পারে, সে জন্য বায়ুদূষণ যন্ত্রে পরিশোধন করা হয়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ধোঁয়া পরিশোধনের পর পাউডার–জাতীয় ছাই পাওয়া যায়। তা বড় বস্তায় ভরে রপ্তানি করা হয়।

জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান কাজী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুতে ছাই ফেলে দেওয়া হতো। তবে বিদেশে ভালো বাজার থাকায় রপ্তানির উদ্যোগ নিই আমরা। এখন নিয়মিতই রপ্তানি হচ্ছে। মোট ছাই রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশি করছে বিএসআরএম।’

জানা গেছে, বিএসআরএম শুরুতে তাদের চট্টগ্রামের নাছিরাবাদের বিলেট কারখানা থেকে ছাই রপ্তানি করত। তা পরিমাণে ছিল কম। বর্তমানে গ্রুপটির চারটি কারখানায় পুরোনো লোহার টুকরা গলিয়ে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন বিলেট তৈরি হচ্ছে। এই গ্রুপ বছরে ১২ হাজার টন ছাই রপ্তানি করে থাকে। ২০২০–২১ অর্থবছরে এই খাত থেকে গ্রুপটির রপ্তানি আয় হয়েছে ৬২ লাখ ডলার বা ৫৩ কোটি টাকা। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বিএসআরএম গ্রুপ ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা ২০০ কোটি টাকার ছাই রপ্তানি করেছে।

এদিকে বিশ্ববাজারে জিংক অ্যাশ বা ছাইয়ের দাম গত দুই বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এখন প্রতি টন ছাই ৮০০–৯০০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি কেজি ছাই ৮০–৯০ সেন্ট বা ৬৮ থেকে ৭৭ টাকায় রপ্তানি হয়। বছর দুয়েক আগে প্রতি টনের রপ্তানি মূল্য ছিল ৪০০ ডলার। রপ্তানিকারকেরা জানান, বিশ্ববাজারে পাটখড়ির ছাইয়ের চেয়ে ইস্পাত কারখানার ছাইয়ের দাম বেশি।

বায়ূদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি আমরা। সেই টাকা উঠে গেছে। ছাই রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া হলে অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগ করবেন।
তপন সেনগুপ্ত, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসআরএম গ্রুপ

উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা গেছে, এখনো দেশের গুটিকয়েক কারখানা অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে ধোঁয়া প্রক্রিয়াজাত করছে। বড় ও মাঝারি কারখানাগুলোর সব কটি অত্যাধুনিক যন্ত্র স্থাপনে বিনিয়োগ করলে ছাই রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে। তাতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পরিমাণও বাড়বে।

জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ূদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি আমরা। সেই টাকা উঠে গেছে। ছাই রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া হলে অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগ করবেন। এতে যেমন পরিবেশ সুরক্ষা হবে, তেমনি রপ্তানি আয়ও বাড়বে।