কারখানায় লোক মিলছে না, শিক্ষিতেরা চান বড় চাকরি

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সানেম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে শিল্পোদ্যোক্তা সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এ কথা বলেন।

শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাজের জন্য কারখানায় নেওয়া যায় না। সবাই বড় বড় পদে চাকরি করতে চান। সবাই গবেষক হতে চান, অর্থনীতিবিদ হতে চান। শিক্ষিত সবাই যদি সেবা খাতে চলে যান, তাহলে কৃষিকাজ কারা করবেন কিংবা উৎপাদন খাতে কারা যাবেন। শিক্ষার্থীদের এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং শিক্ষা’ শিরোনামের এক আলোচনায় অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর এসব কথা বলেন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত এ আলোচনায় তিনি অতিথি বক্তা ছিলেন। সভায় আরও বক্তব্য দেন পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এম এম আকাশ, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো সোহেলা নাজনীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, গত ৫০ বছরে কৃষি, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনাতে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যতটা উন্নতি হওয়ার কথা, ততটা হয়নি। এ সময়ে বেড়েছে আয়বৈষম্য। বক্তারা বলেন, যে বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, বাংলাদেশের ৫০ বছর পর এসে সেই বৈষম্যই প্রকট হয়ে উঠেছে।

খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দেশ স্বাধীনের সময় ৯২ শতাংশ মানুষ গ্রামে ছিল। এখন সেটা কমে ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু এ নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। ফলে গ্রামীণ সমস্যা শহরেও দেখা যাচ্ছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। আয়বৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি, বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল।

দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। আয়বৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কারখানায় নিয়ে যেতে চাইলে তাঁরা যেতে রাজি হচ্ছেন না। সবাই ভালো পদে যেতে চান। অর্থনীতিবিদ হতে চান। আমাদের কি আসলে এত অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন আছে? কৃষি ও ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদন) খাতে তরুণদের আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সবাই যদি সেবা খাতে যেতে চান, অন্য খাত চলবে কীভাবে?’

নাসিম মঞ্জুরের এ বক্তব্যের পর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে জাতীয় বেকারের হার যেখানে ৪ শতাংশ, সেখানে শিক্ষিত বেকারের হার ১২ শতাংশের বেশি। বাজারে দক্ষ মানুষের যে চাহিদা, তা জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিল্পের সঙ্গে পড়াশোনার সংযোগটা কম। তিনি বলেন, সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। হাইটেক পার্ক করছে। সেখানে এক কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বলছে সরকার। কিন্তু সেখানে কী ধরনের কর্মসংস্থান হবে। কাদের কর্মসংস্থান হবে, আমরা কিছু জানি না। এ বিষয়ে যাঁরা কাজ দেবেন, তাঁদের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।

এম এম আকাশ তাঁর বক্তব্যে বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে শিক্ষার পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতে এখন যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে উচ্চ ধনী হওয়ার গতি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। আয়বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় দেশে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে আগে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। যেমনটা ৬ দফা, ১১ দফা ঠিক করা হয়েছিল। তাহলেই পরিবর্তন সম্ভব।

সায়মা হক বলেন, ৫০ বছরে কৃষি, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুতে বাংলাদেশের অনেক অর্জন আছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান নিয়ে চ্যালেঞ্জ আছে। সম্পদের সুষম বণ্টনও বড় চ্যালেঞ্জ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সোহেলা নাজনীন বলেন, ‘আমরা যে বলছি বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে, নারীর অগ্রগতি হচ্ছে, সেটার পরিমাপ কী? মুখে বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। নারীর ক্ষমতায়নে কেন শুধু নারীরাই আন্দোলন করবেন? নারী কী পোশাক পরে বের হচ্ছেন, আমরা এখনো সেটা নিয়ে আলোচনা করি।’