গ্যাস–সংকটে বিপাকে শিল্পমালিকেরা

অনেক কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার ৩০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে। এ সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।

গ্যাস
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের ভবানীপুরের মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস সুতার পাশাপাশি ডাইং ও তৈরি পোশাক উৎপাদন করে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। কিন্তু চার-পাঁচ মাস ধরে গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। কারখানাটির অনুমোদিত গ্যাসের চাপ হচ্ছে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। গত শনিবার সারা দিন সেই চাপ ছিল ১-৫ পিএসআইয়ের মধ্যে।

মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘গ্যাস–সংকটে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা ১০ কোটি টাকা খরচ করে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছি। ডিজেল জেনারেটর স্থাপন করেছি। তারপরও আশি–নব্বই শতাংশের বেশি উৎপাদন করতে পারছি না। যদিও কারখানার জ্বালানি বাবদ খরচ ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।

গ্যাস–সংকটের কারণে মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের মতো পোশাক ও বস্ত্র খাতের অনেকগুলো কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার গত ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমেছে। সরবরাহ নেমে এসেছে অর্ধেকে। গ্যাসের উৎপাদনে চাপ কমে আসায় সম্প্রতি বিবিয়ানায় সংস্কারকাজ শুরু করেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। এ কাজ আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হতে পারে। এটি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস উৎপাদন ক্ষেত্র হওয়ায় নতুন করে মাওনা, কোনাবাড়ীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা, সাভার-আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের কারখানাগুলো সমস্যার প্রকট হয়েছে বলে জানালেন পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা।

সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিল চার বছর ধরে গ্যাস–সংকটের মধ্যে রয়েছে। কারখানাটির অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১০ পিএসআই হলেও দিনের বেলা (কারখানার উৎপাদনের সময়) কখনোই ২-৩ পিএসআইয়ের বেশি পাওয়া যায় না। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় ইতিমধ্যে মিলের ৩০-৪০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে ৪ বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৪৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে লিটল স্টার স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কম করে হলেও ৪০টি বৈঠক করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছি। ডিজেল জেনারেটর কিনেছি। তারপরও দিনে যেখানে ২৬ হাজার পাউন্ড সুতা উৎপাদনের কথা, সেখানে উৎপাদন করতে পারছি মাত্র ১৫ হাজার পাউন্ড।’

আক্ষেপ করে খোরশেদ আলম বলেন, ‘গ্যাস–সংকটের কারণে ৮ বছরে ১৬ কোটি টাকা লোকসানের পর বাইপাইলের একটি স্পিনিং মিল বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের যা অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে আর ব্যবসা সম্প্রসারণে যাব না। নতুন ইউনিট করার জন্য যেসব প্লট কিনেছিলাম, সেগুলোও বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় প্রচুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। সেটি আগামী ছয় মাস পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে ধারণা করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা। ভরপুর ক্রয়াদেশের প্রতিফলনও তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও দেখা যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে ৪০৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ। ওই মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের যা অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে আর ব্যবসা সম্প্রসারণে যাব না। নতুন ইউনিট করার জন্য যেসব প্লট কিনেছিলাম. সেগুলোও বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
খোরশেদ আলম, চেয়ারম্যান,লিটল স্টার স্পিনিং মিল

গ্যাস–সংকটের কারণে কোনাবাড়ী, সাভার, আশুলিয়াসহ কয়েকটি এলাকার ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না বলে জানালেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, গ্যাস–সংকটে ইতিমধ্যে ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। সময়মতো উৎপাদন করতে না পারায় অনেকেই নিজ খরচে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে কারখানাগুলো দেনার দায়ে জর্জরিত হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুটের মতো। কয়েক মাস আগেও ৩২০ থেকে ৩৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা গেছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে বিদ্যুৎ, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক, শিল্পকারখানা—সব খাতেই গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সিএনজি স্টেশন দিনে চার ঘণ্টা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এক খাত থেকে কমিয়ে আরেক খাতে সরবরাহ বাড়িয়েও (রেশনিং) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে গাজীপুরের মাওনা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অবস্থা খুবই খারাপ। এই দুই এলাকার কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৩০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে। এ সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, বস্ত্রকলগুলো রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমদানির আগেই এলএনজির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন এলএনজিও পাচ্ছি না, প্রাকৃতিক গ্যাসও পাচ্ছি না। আমরা তাহলে যাব কোথায়?’