টেকসই পোশাকশিল্পের জন্য যা দরকার
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর হিসেবে ২০২১ সাল আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের সমৃদ্ধির খাতায় যোগ হয়েছে অভাবনীয় সব সাফল্য। যার মধ্যে অন্যতম—৮ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার, ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি। তা ছাড়া গত দুই দশকে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন, মানব উন্নয়ন সূচক এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে আমাদের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই অর্জন জাতি হিসেবে সত্যিই গর্বিত করে আমাদের।
করোনার প্রাদুর্ভাবে বর্তমানে আমরা শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ সময় পার করছি। যদিও বিশ্ব অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিতে অতিমারির প্রভাব এড়ানো অসম্ভব, তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে রয়েছি।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের শিল্পায়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে। এই অগ্রগতিকে মাথায় রেখে আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আগামী দিনের প্রবৃদ্ধি শিল্প খাত দ্বারা পরিচালিত হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান—এই দুটি বিষয়ে মনোনিবেশের বিকল্প নেই।
গত চার দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পোশাক খাতের ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন, যা বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছে। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেন, যার ৬০ শতাংশই নারী। তবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও পণ্য ও রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির ৭৩ শতাংশই পাঁচটি পণ্যে সীমাবদ্ধ। সেগুলো হচ্ছে—টিশার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটার, জ্যাকেট ও কটন শার্ট। এ ছাড়া আমাদের ৭৫ শতাংশ পণ্যই কটনের তৈরি, যেখানে বিশ্বে বস্ত্র ও পোশাক বাজারের মাত্র ২৫ শতাংশ হচ্ছে কটন। বৈশ্বিক বাজারে নন-কটন পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও গত ১০ বছরে আমাদের রপ্তানি কটননির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
আমাদের রপ্তানি বাজারের চিত্রও একই রকম। পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮১ শতাংশই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র বাজারনির্ভর। গত কয়েক দশকে ইউরোপে আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে কিছুটা কমেছে, অপ্রচলিত বাজারগুলোতে পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা গতি এসেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির হার ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা বিদায়ী বছরে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থের হিসাবে পরিমাণটি ৫০৮ কোটি মার্কিন ডলার। এটিকে আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। মূলত নতুন বাজারে প্রণোদনা ও উদ্যোক্তাদের পরিশ্রমের ফলেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ জন্য গত এক দশকে নতুন বাজার সম্প্রসারণে বিজিএমইএর বিভিন্ন পদক্ষেপও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোশাকশিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন, সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। তবে বাজার বা পণ্য বহুমুখীকরণে অনেকটাই পিছিয়ে আছি। করোনা–পরবর্তী বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
ইতিমধ্যে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে প্রবেশের লক্ষ্যে ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলিসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ। ২০১০ সালে আমরা প্রথমবারের মতো লাতিন আমেরিকায় ট্রেড মিশন পাঠাই। পরবর্তী বছরে ফলোআপ মিশনের আয়োজন করা হয়। ব্রাজিলের মেলায় অংশগ্রহণ করেছি আমরা। ২০১১ সালের আগে লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে বাংলাদেশের কিংবা বাংলাদেশে লাতিন আমেরিকার কোনো দূতাবাস ছিল না। আমাদের অনুরোধে সরকার ব্রাজিলে বাংলাদেশের দূতাবাস চালু করে। একই সঙ্গে ব্রাজিলও ঢাকায় তাদের দূতাবাস স্থাপন করে। এর ফলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে আমাদের ভিসা, ভ্রমণ ও বাণিজ্য সহজ হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে লাতিন আমেরিকার প্রধান বাজার যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, পেরু, কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও পানামাতে আমাদের মোট পোশাক রপ্তানি ছিল ১২ কোটি ডলার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে ৫১ কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া চীন, জাপান ও রাশিয়ায় বাণিজ্য মিশনের আয়োজন করেছে বিজিএমইএ। নতুন বাজারে আমাদের রপ্তানির গতি ধরে রাখতে এই উদ্যোগগুলো পুনরায় চালু করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের বাজার আমাদের জন্য সম্ভাবনাময়। এসব বাজারে রপ্তানি প্রসারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে নতুন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক। বেশ কিছু দেশে আবার অশুল্ক বাধাও আছে। এই দেশগুলোতে বাজারসুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলাপ–আলোচনা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছে, যা রপ্তানি খাতকে ভবিষ্যতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। বিশেষ করে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা। যদিও সামনের কয়েকটি বছর আমরা বিদ্যমান বাজারসুবিধাগুলো পাব। তবে সামনের দিনে সে হিসাব অনুযায়ী এগোলে চলবে না। আগামী বছরগুলোতে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হলে এখনই সঠিক কৌশলের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক চুক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাণিজ্য নীতিমালার সঙ্গে মিল রেখে একটি জাতীয় রপ্তানি কৌশল প্রণয়ন করা দরকার।
বাংলাদেশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নেই। অবশ্য সাফটা, বিমসটেকের মতো কয়েকটি আঞ্চলিক চুক্তি রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশ সরকার চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব পেয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ইউরেশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির বিষয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে অনেক অপ্রচলিত বাজারে যেমন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও চীনে আমাদের শুল্কমুক্ত প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। এসব বাজারে এখন থেকেই কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে।
পাশাপাশি আমাদের প্রধান দুটি বাজার—ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরও কৌশলী হতে হবে। কারণ, এই দেশগুলোতে আমাদের সিংহভাগ পণ্য রপ্তানি হলেও আরও অনেক সম্ভাবনা আছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা এখনো পণ্যের সীমিত বৈচিত্র্যসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করছে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যেসব ব্র্যান্ড সীমিত পরিসরে পোশাক আমদানি করছে বা একেবারেই আমদানি করছে না, তাদের কাছে আমাদের শিল্পকে তুলে ধরা এবং যেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেসব পণ্যের প্রচার করার পাশাপাশি আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি, টেক্সটাইল এবং উচ্চমানের ফ্যাশনশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমাদের প্রচারণা বাড়াতে হবে। পোশাক রপ্তানিতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি ও নতুন নতুন দক্ষতা তৈরি জন্য বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হলেও দেশের সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে মূলত উৎপাদন খাতে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, পোশাক খাতের হাত ধরে। তাই ভবিষ্যতে এই প্রবৃদ্ধিকে আরও টেকসই করতে যথাযথ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিজিএমইএ সংগঠন হিসেবে বাজারসুবিধা আদায়, সংযোগশিল্প গড়ে তোলা ও তৈরি পোশাক বিক্রির জন্য ভার্চ্যুয়াল মার্কেটপ্লেস গড়ে তোলার কাজ করছে। তবে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আঞ্চলিক চুক্তি, আর্থিক নীতিমালা এবং শুল্ক ও অশুল্ক বাধাসহ বিদ্যমান বাণিজ্যিক সমস্যাগুলো নিরসনে কূটনীতিক উদ্যোগ দরকার।
লেখক: ফারুক হাসান, সভাপতি, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ