তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই যাঁর লক্ষ্য

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একঝাঁক এসএমই উদ্যোক্তা আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করে চলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চোখের সামনে কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও ভেঙে পড়েন না, কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদে নিঃস্ব হলেও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেন, কেউ কেউ সোনালি আঁশের নবজাগরণের জন্য কাজ করেন। এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ ছয়জন স্বপ্নজয়ী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে ‘আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২১’। তাঁদের মধ্যে শিক্ষায় আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার পেয়েছেন ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মো. মনির হোসেন

শিক্ষায় আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার–২০২১ বিজয়ী ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মনির হোসেন
প্রথম আলো

২০০৮ সাল। ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় এবং এরই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রে আকাশসমান স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু করেন মো. মনির হোসেন। সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের আত্মপ্রত্যয়ী এক তরুণ, যিনি পড়াশোনার পাশাপাশি ভেবেছিলেন কর্মসংস্থানের এক নতুন ঠিকানা হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন কিছু করার প্রত্যয়ে তাঁর এই ভিন্ন ভাবনা। অন্যদের মতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি কর্মকর্তা, এসব পেশা কখনো আকৃষ্ট করেনি এই স্বপ্নবান তরুণকে। এই কর্মোদ্যমী তরুণ স্বপ্ন দেখেছেন ‘উদ্যোক্তা’ হওয়ার। তাই তো ছোট পরিসরে প্রায় শূন্য হাতে গুটি কয়েকজনকে নিয়ে সূচনা করেন ‘ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট’ ।

তখন দেশে ফ্রিল্যান্সিং-আউটসোর্সিংয়ের কাজ মাত্র গতি পেতে শুরু করেছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে অনেকেই ফ্রিল্যান্সার হতে চান। এই ক্ষেত্রের সম্ভাবনা দেখেই মনির হোসেন ক্রিয়েটিভ আইটিতে শুরু করলেন গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন, অ্যানিমেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিশ্বের বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসের উপযোগী করার কাজও।

অতিথিদের সঙ্গে এসএমই পুরস্কার ২০২১ পাওয়া বিজয়ীরা। (বসা, বাঁ থেকে) মো. ওলি উল্লাহ, রেহানা আক্তার, ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, রাজিয়া সুলতানা, মো. মনির হোসেন ও কামরুন্নাহার খানম। (দাঁড়িয়ে, বাঁ থেকে) মো. জাকের হোসেন, মির্জা নূরুল গণী, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, এম জামাল উদ্দিন, মুহম্মদ গাজী তৌহীদুর রহমান ও মতিউর রহমান। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে
প্রথম আলো

একদিকে নতুন প্রতিষ্ঠানের পথচলা আর অন্যদিকে আর্থিক অবস্থার অবনতি, দুটো পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া প্রায় বেসামাল। শেষ ভরসা পরিবার, বাবা-মায়ের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিলেন মনির হোসেন। শুরু হলো রাতকে দিন করার পরিশ্রম।

এরই মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন আন্তর্জাতিক বাজারে আইটি খাতে কাজের সুযোগ ব্যাপক, তবে অভাব দক্ষ মানুষের। তাই এবার তিনি ভাবলেন ভিন্নভাবে, ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে তৈরি হওয়া জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে শুরু করলেন ‘ক্রিয়েটিভ ক্লিপিং পাথ’ নামক প্রতিষ্ঠানের। এভাবেই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন মনির হোসেন।

২০১৪-১৫ সালে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মনির হোসেন আইটি ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ার কাজ করে যাচ্ছিলেন সফলতার সঙ্গে। কিন্তু কথায় আছে না কারও এগিয়ে যাওয়া অন্যের চোখের কাঁটা? একদল স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর এই সফলতাকে মেনে নিতে পারছিলেন না, এক দিনের নোটিশে হারালেন সব সরকারি কাজ। এই অসত্য অভিযোগ তাঁকে পিছিয়ে দিল দেড়টি বছর, কিন্তু স্বপ্ন তো আর গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় না? বরং এসব তাঁর জীবনে শিক্ষা হয়ে দ্বিগুণ কর্মশক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

‘এই সময়ে আমি বুঝতে পেরেছি, নিজের প্রতিষ্ঠানকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এবং সেই লক্ষ্যেই কাজে মনোযোগ দিলাম’—কথা প্রসঙ্গে এভাবেই বলছিলেন মনির হোসেন। ২০১৬ সালে শুরু করলেন অভিনব আরেক উদ্যোগ, ইনস্টিটিউটের অধীনে শুরু করলেন অনলাইন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা। এর নাম দিলেন ‘ক্রিয়েটিভ ই-স্কুল’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সময়োপযোগী সকল প্ল্যাটফর্মে অবাধ বিচরণ শুরু করলেন।

২০২০ সালে অতিমারি করোনা যেন মনির হোসেনের জন্য হলো শাপেবর। পুরো বিশ্বে তখন একমাত্র ভরসা তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন। ক্রিয়েটিভ আইটির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেশসীমা ছাড়িয়ে হলো বিশ্বব্যাপী। অফলাইন ও অনলাইনে শিক্ষার্থী সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনির হোসেনও যেন দেখা পেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো ক্রিয়েটিভ আইটি। দীর্ঘ ১৩ বছরের পথচলায় ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে এই পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও অধিক তরুণ দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে পেয়েছে সাফল্যের দেখা, বদলেছে নিজেদের ভাগ্য। ৫ লাখের অধিক তরুণ বিনা মূল্যে পেয়েছে আইটিবিষয়ক ক্যারিয়ার গাইডলাইন। জব প্লেসমেন্টের সহায়তায় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে অসংখ্য তরুণ। এদের অনেকেই নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে হয়েছেন উদ্যোক্তা।

শুধু যে তরুণদের বিষয়ে ভেবেছেন মনির হোসেন, তা কিন্তু নয়! নারী, জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও শারীরিকভাবে যাঁরা অক্ষম তাঁদের স্বাবলম্বী করার কথাও ভেবেছেন করোনার মতো এই অতিমারির সময়ে। নিজ অর্থায়নে ট্রেনিং দিয়েছে ১ হাজার ৫০০ নারীসহ ৬ হাজার শিক্ষার্থীকে। ২০০ শারীরিক প্রতিবন্ধী পেয়েছে আইটি প্রশিক্ষণ ও ২ হাজারের বেশি প্রশিক্ষণার্থী পেয়েছে ইন্টার্নশিপের সুযোগ।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মনির হোসেনের এই অনুকরণীয় অবদান এখন সবার সামনে এসেছে। উদ্যোক্তা মনির হোসেন পেয়েছেন ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা ২০২০, জেসিআই টেন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং পারসন অব বাংলাদেশ ২০২১, বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ডসহ অগণিত স্বীকৃতি। এ ছাড়া এরই মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সঙ্গেও একাডেমিক পার্টনার হিসেবে কাজ করছে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট।

২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মনির হোসেন প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্রিয়েটিভ ক্লিপিং পাথ, ক্রিয়েটিভ জুনিয়রস, ব্রাইট স্কিলস, সফটালজিসহ ১১টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে ক্রিয়েটিভ আইটি শুধু দেশেই নয় বিশ্বে সেরা প্রফেশনাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে, সেটাই মনির হোসেনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। সেই লক্ষ্যেই তাঁর পথচলা।