সম্ভাবনা হাত ধরেছে নকশিকাঁথার

যশোরের নকশিকাঁথার ইতিহাস ৩০০ বছরের পুরোনো। তবে গত শতকের সত্তরের দশকে তা বাণিজ্যিক রূপ পায়। আর এখন এটির বিকাশ ঘটছে।

দিনের বেলা সংসারের কাজের পর সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নকশিকাঁথা তৈরি করেন যশোরের এই নারীরা। এভাবে দলবদ্ধভাবে দেড় থেকে দুই মাসে তৈরি হয় একটি নকশিকাঁথা
ছবি: সংগৃহীত

ছোট্ট একটা কক্ষে গোল হয়ে বসে আছেন পাঁচ নারী। তাঁরা সবাই মিলে একটি কাপড়ে সুই-সুতার ফোঁড় দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তুলছেন। এই দৃশ্য যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সিংহের খাজুরা গ্রামের ইয়াসমিন আরার বাড়ির। তাঁরা দিনে সংসারের অন্যান্য কাজ করেন, আর সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নকশিকাঁথা তৈরির কাজ করেন। এভাবে দলবদ্ধভাবে দেড় থেকে দুই মাস কাজ করার পর তৈরি হয় একটি নকশিকাঁথা।

ইয়াসমিন আরা বলেন, ‘আমি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে আসি এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নকশিকাঁথা বানিয়ে দিই।’

কেবল অভয়নগরে নয়, যশোর জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও নকশিকাঁথাসহ বিছানার চাদর, ব্যাগ, কুশন কাভার, শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবিতে নকশা তোলার কাজ করেন সূচিশিল্পের কারিগরেরা। তাঁদের তৈরি এসব পণ্য চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার নামীদামি বিপণিবিতানে।

আমরা যশোর নকশিকাঁথা ক্লাস্টারটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও হেরিটেজ মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি।
মো. মফিজুর রহমান এমডি, এসএমই ফাউন্ডেশন

৩০০ বছরের পুরোনো শিল্প

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোরের নকশিকাঁথার ইতিহাস প্রায় তিন শ বছরের পুরোনো। এ সম্পর্কে ঝিকরগাছা উপজেলার ইতিহাসবিদ হোসেনউদ্দীন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই নকশিকাঁথা যশোরের সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। কিন্তু এটি বাণিজ্যিক রূপ পায় গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে। সে সময় একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) স্থানীয় সূচিশিল্পীদের দিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নকশিকাঁথা বানানোর কাজ শুরু করে। এরপর স্থানীয় অনেক উদ্যোক্তা এই ব্যবসায় যুক্ত হন।

এই শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি নকশিকাঁথা তৈরির কাজ হয় শার্শা, মনিরামপুর, চৌগাছা, ঝিকরগাছা ও সদর উপজেলায়। তবে গোটা জেলায় উদ্যোক্তা ও সূচিশিল্পীদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে কোনো জরিপ বা তথ্য কারও কাছে নেই। উদ্যোক্তারা বিভিন্ন এলাকায় সূচিশিল্পীদের ছোট ছোট দলে (১০-১২ জনের) ভাগ করে কাজ দেন। এসব দলকে তাঁরা ‘ফিল্ড’ বলে ডাকেন।

জোয়ানা বুটিক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা রোকসানা পারভীন বলেন, ‘একেকটি নকশিকাঁথা সেলাই করতে অন্তত দুজন কর্মীকে কাজ করতে হয়। এতে প্রতিটি নকশিকাঁথা সেলাই করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস লাগে। এভাবে একটি ফিল্ডে বছরে ১০০টির মতো নকশিকাঁথা তৈরি হয়। আমার চারটা ফিল্ডে বছরে ৪০০টির মতো কাঁথা আসে। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যে নকশা তুলতে ৫ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে।’

নকশিকাঁথার যত বাহারি নাম

নকশিকাঁথাশিল্পের উদ্যোক্তা ও প্রাপ্তি ফ্যাশনের মালিক আহাদুজ্জোহা রুবেল জানান, ধরন অনুসারে নকশিকাঁথার নানা নাম রয়েছে। যেমন লাহোরি কাঁথা, সুজনী কাঁথা, যশোর স্টিচ, শান্তিপুরী সেলাই ইত্যাদি। সেলাইয়েরও আছে বাহারি নাম—হাসিয়া, বেকি নকশি, কাঁথা স্টিচ, বরফি সেলাই, টানা সেলাই ইত্যাদি।

সূচিশিল্পের কারিগরেরা জানান, নকশিকাঁথায় বেকি, শামুক মোড়, হাঁটুভাঙা, ঘরের মধ্যে ঘর, বাসুই, তাঁতি, গীত, ভরাট ইত্যাদি নামের পাড় যুক্ত করা হয়। এই কাঁথা তৈরিতে কাপড় আর সুই-সুতা ছাড়াও কাগজের ওপর আঁকা নকশা, ট্রেসিং পেপার ও ফ্রেম ইত্যাদি দরকার হয়।

উদ্যোক্তারা জানান, তাঁরা ঢাকার ইসলামপুর, নরসিংদীর বাবুর হাট ও যশোরের স্থানীয় বাজার থেকে নকশিকাঁথা তৈরির কাপড় কিনে আনেন। সুতা কেনা হয় ঢাকার নিউমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেট থেকে। সুতা কিনতে হয় তিন–চার ধরনের।

উদ্যোক্তা ও কারিগরেরা জানান, মূলত কাঁথার আকার ও নকশার ওপর নির্ভর করে মজুরির পরিমাণ। সাধারণত একটি কাঁথার জন্য প্রায় তিন হাজার টাকা এবং অন্যান্য পণ্যের জন্য ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরি দিতে হয় কারিগরদের। প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা এই কাজ করে একেকজন কর্মী মাসে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন।

বছরে ১২ কোটি টাকার কাঁথা বিক্রি

যশোরের প্রতিটি নকশিকাঁথা সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। নকশা করা একেকটি শাড়ির দাম ২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। নকশা করা অন্যান্য পণ্যের দাম পড়ে ৩০০ থেকে ৬ হাজার টাকা।

যশোর নকশিকাঁথা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহাদুজ্জোহা রুবেল প্রথম আলোকে বলেন, একজন উদ্যোক্তা মাসে গড়ে ১ লাখ টাকার মতো পণ্য বিক্রি করতে পারেন। তাঁদের সংগঠনে শতাধিক স্থানীয় উদ্যোক্তা যুক্ত আছেন। সেই হিসাবে মাসে গড়ে ১ কোটি ও বছরে ১২ কোটি টাকার নকশিপণ্য বিক্রি হয় বলা যায়। তবে সংগঠনের বাইরে থাকা উদ্যোক্তাদের হিসাবে ধরলে বিক্রির পরিমাণ ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা রুবেলের।

দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডও যশোর থেকে নকশিপণ্য বানিয়ে নেয়।

উদ্যোক্তাদের তিন দাবি

উদ্যোক্তারা নিজেদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও পণ্য বিপণনের প্রদর্শনীকেন্দ্র এবং কারিগরদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চান। তাঁরা বলেন, যশোরের সূচিশিল্প ও নকশিকাঁথার ঐতিহ্য অনেক দিনের হলেও এখনকার কাজে বৈচিত্র্য কম।

ফাতেমা খাতুন নামের একজন উদ্যোক্তা বলেন, অধিকাংশ কর্মীই একটি নির্দিষ্ট নকশায় কাজ করেন। তাই কর্মীদের কাজে বৈচিত্র্য আনতে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

যশোর নকশিকাঁথা সমিতির সভাপতি ও টুইংকেল ক্র্যাফটের মালিক মরিয়ম নার্গিস বলেন, ‘সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় ও প্রদর্শনীকেন্দ্র
না থাকায় উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়েন এবং উৎপাদন খরচের তুলনায় উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না।’ তিনি জানান, করোনার মধ্যে অনেকেই অসুবিধায় পড়েছিলেন।

সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় ও প্রদর্শনীকেন্দ্র না থাকায় উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়েন এবং উৎপাদন খরচের তুলনায় উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না।
মরিয়ম নার্গিস সভাপতি, যশোর নকশিকাঁথা সমিতি

হাত বাড়াল এসএমই ফাউন্ডেশন

সব সূচিশিল্পী তথা কারিগর সব ধরনের নকশা তোলার কাজ করতে কিংবা সেলাইয়েও বৈচিত্র্য আনতে পারেন না, আবার উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ ও পণ্য বিপণন নিয়ে সমস্যায় পড়েন। এসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটি যশোরের নকশিকাঁথাশিল্পকে একটি বিশেষ অঞ্চল বা ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করে এখন উদ্যোক্তাদের ঋণ ও কারিগরদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।

এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, তারা পুরো জেলায় নকশিকাঁথাশিল্পের প্রায় পাঁচ শ উদ্যোক্তাকে নিয়ে কাজ করে। এসব উদ্যোক্তার অধীনে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার সূচিশিল্পী, যাঁদের প্রায় সবাই নারী।

জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা যশোর নকশিকাঁথা ক্লাস্টারটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও জাতীয়, আঞ্চলিক ও হেরিটেজ মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। এ ছাড়া নকশিকাঁথা শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে প্রায় ২২ লাখ টাকা ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’


প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি যশোর