সাক্ষাৎকার
সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে, ব্যবসায়ীদেরও করতে হবে
সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সম্প্রতি সংস্থাটির নতুন নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) অষ্টম ব্যাচের এই কর্মকর্তা কথা বলেছেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আরিফুর রহমান।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে শিল্পকারখানা স্থাপনে অগ্রগতি কেমন দেখছেন?
শেখ ইউসুফ হারুন: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে আমাদের হাতে এখন ২১ হাজার একর জমি রয়েছে। সামনের দিনে জমির পরিমাণ আরও বাড়বে। এই শিল্পনগরে শিল্পকারখানা স্থাপনে অগ্রগতি বেশ ভালো। ১৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এর মধ্যে এশিয়ান পেইন্টস, ম্যাকডোনাল্ড-নিপ্পনসহ চার–পাঁচটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ বছর উৎপাদনে যাওয়ার মতো অবস্থানে রয়েছে। তবে করোনাভাইরাস উদ্যোক্তাদের কাজের গতি কিছুটা কমিয়েছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বিনিয়োগকারীদের জন্য আপনারা কী কী সুবিধা দিচ্ছেন?
ইউসুফ হারুন: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগকারীদের জন্য আমরা রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দিচ্ছি। তাদের জন্য গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সরকার বেসরকারি খাতকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার অনেক কিছুই পূরণ হয়েছে। তবে এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো আমরা দ্রুত শেষ করব। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আমরা একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যে প্রকল্পের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জন্য বাকি কাজ করে দেব। তবে সরকার যেমন প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত ১২২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমি লিজসংক্রান্ত চুক্তি সই হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শ্রমিকদের থাকার বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
ইউসুফ হারুন: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের ফেনীর অংশ শ্রমিকদের আবাসনের জন্য রাখা হচ্ছে। সেখানে এক হাজার একর জায়গার ওপর আবাসিক এলাকা গড়ে উঠবে। আশা করছি শ্রমিকদের থাকার কোনো সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে একটি বন্দর করার দাবি ব্যবসায়ীদের। সেখানে বন্দর করার বিষয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে?
ইউসুফ হারুন: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বন্দর করা নিয়ে জাপানের সুজিত করপোরেশনকে সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করছি নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের কাছ থেকে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি পাব। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে সেখানে বন্দর হবে কি না। তবে আশা করছি, সেখানে ব্যবসায়ীদের বন্দরসুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে। ভারতের একটি কোম্পানি অস্থায়ীভাবে তাদের মালামাল আনার জন্য একটি জেটি করছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানির সমস্যা নিয়ে ব্যবসায়ীরা কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
শেখ ইউসুফ হারুন: পানির নিশ্চয়তা ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কতটুকু পানির প্রয়োজন, আমরা প্রথমে চাহিদা নিরূপণ করেছি। সেখানে পানির চাহিদা মেটাতে ৩৫টি গভীর নলকূপ বসানো হবে। মাতামুহুরী নদী থেকে পানি আনা হবে। মেঘনা নদী থেকেও ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে পানি আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া যারা শিল্পকারখানা করছে, তারাও নিজেদের উদ্যোগে পানির ব্যবস্থা করছে। আমরা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর জোর দিচ্ছি না। কারণ, এটি পরিবেশের ক্ষতি করে। আমরা ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত দেশি বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ইউসুফ হারুন: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে আমাদের দেশি অনেক কোম্পানি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করছে। সে জন্য আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ কম। এখানে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য এক হাজার একর জমি দেওয়া হয়েছে। জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক হাজার একর জমি দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ আছে এখানে। আমরা সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানার বিনিয়োগকে যেমন অগ্রাধিকার দিই, তেমনি যৌথ বিনিয়োগকেও গুরুত্ব দিই, উৎসাহিত করি। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিদেশি বিনিয়োগ কম, এটা বলা যাবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি কেন? পছন্দের জায়গায় শীর্ষে কেন মিরসরাই?
ইউসুফ হারুন: সরকারের নীতি হলো যেখানে–সেখানে এলোমেলোভাবে শিল্পাঞ্চল করা যাবে না। শিল্পকারখানা করতে হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে তুলনামূলক আগ্রহ বেশি হওয়ার কারণ হলো, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরসুবিধা আছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের পাশে বিমানবন্দর রয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এসব কারণে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ বেশি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো : আপনার তিন বছরে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরকে ঘিরে পরিকল্পনা কী?
ইউসুফ হারুন: নতুন কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের দিকে নজর দেব না। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কাজ শেষ করার চেষ্টা থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে, তিন বছর খুব অল্প সময়। তিন বছর সময়ে যত কিছু করা দরকার, তা–ই করব। আমি আশা করব, যারা সেখানে জমি নিয়েছে, তারা দ্রুত কাজ শুরু করবে।