সায় পাচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান

সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে কেবল অনুমোদন পাওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দিকেই বেশি মনোযোগ বেজার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে অনেক কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে তোলা
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের। কিন্তু এখন সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, ততটা পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। সরকারি পর্যায়ে অনুমোদন পাওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দিকেই কেবল নজর রয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা)। বড় কোম্পানিগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য প্রস্তাব জমা দিয়ে রাখলেও ২০১৯ সালের পর একটিও অনুমোদন পায়নি। এতে সরকারের এক কোটি মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি পূরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধারদের অভিযোগ, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাঁদের প্রস্তাবগুলো ফেরত পাঠাচ্ছে বেজা। নতুন করে ব্যক্তি খাতের কাউকে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটির আগ্রহ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার একদিকে পরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে বলছে, অন্যদিকে অনুমোদন দিচ্ছে না। এতে নতুন বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনাও কমছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে তিন বছর আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুমোদন মেলেনি। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য আবেদন করেছে সাদ মুসা গ্রুপ। তাদের প্রস্তাবটিও অনেক দিন ধরে ঝুলছে। মুন্সিগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার আগ্রহ দেখিয়েছে প্রিমিয়ার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অঞ্চল। এ প্রস্তাবেও অনুমতি মেলেনি। বাংলাদেশ, চীন, জার্মানির কয়েকজন ব্যবসায়ীর ভোলা সদরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও ঝুলছে এক বছরের বেশি সময় ধরে।

জানতে চাইলে প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হাসান ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা করেছেন। বেজা নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে। আমরা সেসব তথ্য দিচ্ছি।’

বেজার তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ ২০১৯ সালে বেসরকারি খাতে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এখন চলছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, একটা সময় বেসরকারি খাতকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে আনার বিষয়ে সরকার উদার ছিল। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা কথা রাখেননি। তাই পুরোনো যেগুলোর কাজ চলছে, যত দ্রুত সম্ভব সেগুলোকে উৎপাদনে আনতে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।

বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, যাঁরা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার অনুমতি পেয়েছেন, তাঁরা প্রণোদনারও অপব্যবহার করছেন। এ কারণে বেজা এখন বেশ সতর্ক। অর্থনৈতিক অঞ্চল করলে বেসরকারি খাতকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ১০ বছর কর অবকাশসুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও এসইজেড প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় বাজার থেকে উপকরণ কেনায় মূসক অব্যাহতির পাশাপাশি পণ্য আমদানিতেও শুল্ক ছাড় রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে দ্রুত গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এসব সুবিধা অন্য কোথাও এত দ্রুত দেওয়া হয় না।

বেজা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সরকার ২৯টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে উৎপাদনও শুরু হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে। এর মধ্যে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১২টি বিদেশি কোম্পানি এসেছে।

জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে নতুন কাউকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমতি দিতে বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারণ, এর আগে ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা বলে পুরোনো শিল্পকারখানাকে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এতে তো নতুন বিনিয়োগ হলো না। অথচ তাঁরা সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। কিছু ব্যবসায়ীর প্রতারণার কারণে সরকার সতর্ক। তার মানে এই নয় যে নতুন করে অনুমোদন দেওয়া হবে না।’

রহিম স্টিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রহিম অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব দিয়েছে। অনেক দিন ধরে এ প্রস্তাব আটকে আছে। এ ছাড়া ভালুকায় মেরিডিয়ান অর্থনৈতিক অঞ্চল, সীতাকুণ্ডে বসুন্ধরা মেগা অর্থনৈতিক অঞ্চল, বগুড়ায় টিএমএসএস অর্থনৈতিক অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিটি গ্রুপ অর্থনৈতিক অঞ্চল, এস আলম গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে অনেক দিন ধরে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানান, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলে কম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। শুধু গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। কয়েকজন ব্যবসায়ীর কারণে পুরো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বন্ধ রাখা ঠিক হবে না বলে মত দেন তাঁরা।