মজুরি আন্দোলনে ভুগেছে পোশাকশিল্প 

সম্ভাবনা থাকলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে দেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাকশিল্প।

তৈরি পোশাকশিল্প খাতছবি: প্রথম আলো

বছরের শুরুতে ক্রয়াদেশ তুলনামূলক কম থাকায় তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সঙ্গে ছিল গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটজনিত উদ্বেগ। এরই মধ্যে নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার। তাতে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার খরচ বাড়ে। যদিও বছরের শেষ দিকে সবকিছু ছাপিয়ে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে চারজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাই বেশি ভুগিয়েছে সর্বোচ্চ রপ্তানির এই খাতকে। 

তৈরি পোশাক খাতের একাধিক উদ্যোক্তা ও শ্রমিকনেতা প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকেরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো শ্রমিক সংগঠন নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার, আবার কিছু সংগঠন তা ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছিল। এ রকম অবস্থায় নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ২ হাজার ৪০০ টাকা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব করেন। তাতে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন।

নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার যদি শ্রম ইস্যুতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তাতে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি 

মালিকপক্ষের ‘অদূরদর্শী’ মজুরি প্রস্তাবকেই শ্রম অসন্তোষের মূল কারণ বলে মনে করেন শ্রমিকনেতারা। তাঁদের অভিযোগ, শুধু অদূরদর্শী প্রস্তাবই নয়, কালক্ষেপণের কৌশলও নিয়েছে মালিকপক্ষ।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয় মজুরি বোর্ড গঠন করে। ছয় মাসে বোর্ডের তিনটি সভা হলেও কোনো পক্ষ প্রস্তাব দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হলে ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চতুর্থ সভায় শ্রমিক ও মালিক দুই পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ ওই সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির প্রস্তাবের অর্ধেক, তথা ১০ হাজার ৪০০ টাকা প্রস্তাব করায় পরদিন থেকেই শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। 

মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের তিন সপ্তাহের আন্দোলনে রাসেল হাওলাদার, ইমরান, জালাল উদ্দিন ও আঞ্জুয়ারা খাতুন নামের চারজন পোশাকশ্রমিক মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মালিকপক্ষ নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৭ নভেম্বর মালিকপক্ষ আগের প্রস্তাবের চেয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। সেটিই পরে চূড়ান্ত হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন এই মজুরি কাঠামো কার্যকর হয়েছে। 

আরও পড়ুন

প্রথম দফায় মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার আগে কিছুসংখ্যক সাধারণ সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেন পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা। বৈঠকে সাধারণ সদস্যরা মতামত দেন, ১২ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি দেওয়ার সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। সেই মতামত অনুযায়ী শুরুতেই প্রস্তাব দিলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতে পারত। 

১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি চূড়ান্ত হওয়ার পরও আন্দোলন চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ, মামলা ও গ্রেপ্তারের পথ বেছে নেয় মালিক ও সরকারপক্ষ। সব মিলিয়ে কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে শুধু গাজীপুর ও আশুলিয়ায় করা ৪৩ মামলায় নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে কমপক্ষে ২০ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ১১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিভিন্ন চাপের মুখে শ্রমিকনেতারা অল্প সময়ের মধ্যে মজুরি নিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দিতে বাধ্য হন। যদিও সবকিছু থেমে যায়নি। পোশাকশ্রমিকদের যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন মার্কিন কংগ্রেসের আট সদস্য। তাঁরা শ্রমিকদের মাসিক ২৩ হাজার টাকার নিম্নতম মজুরির দাবি না মানাকে শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনক বলেও মনে করেন তাঁরা। 

এমন পরিস্থিতিতে ২৩ হাজার টাকা বা ২০৮ ডলারের ন্যূনতম মজুরির দাবি মেনে নিতে সরকার ও তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদকদের চাপ দিতে আমেরিকান অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে (এএএফএ) চিঠি দেন মার্কিন কংগ্রেসের ওই ৮ সদস্য। গত ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের এই সদস্যরা এএএফএর সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী স্টিভেন ল্যামারকে চিঠি দেন। 

মার্কিন শ্রমনীতিতে শঙ্কা

এদিকে মজুরি আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শ্রমনীতির কারণে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। 

বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেন। এতে বলা হয়, যাঁরা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাঁদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। 

বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি কার্যকর করেছে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি সহজভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই, শ্রমিকনেতারা এভাবে উদ্বেগ জানালেও মালিকপক্ষ ছিল চুপচাপ। যদিও সরকার শ্রম আইন সংশোধনের একটি উদ্যোগ শেষ মুহূর্তে স্থগিত করেছে। 

দেশে গত এক দশকে শ্রম অধিকারের বিষয়ে বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। শ্রম আইন বাস্তবায়নে তেমন পরিবর্তন আসেনি। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের হার বাড়লেও বিভিন্নভাবে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে বাধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে শ্রমিকদের ঠকানো হচ্ছে। শ্রমিক হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। শ্রমিকেরা ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামলে হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। 

আরও পড়ুন

শেষ কথা

সম্ভাবনা থাকলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে দেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাতটি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পোশাক রপ্তানিতে পৌনে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলেও গত দুই মাস আবার কমেছে। 

এ নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বছরের প্রথমার্ধে শ্রমিক-সংক্রান্ত ইস্যুতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মজুরি নিয়ে সংকট শেষ হয়নি। গ্রেড নিয়ে জটিলতা রয়েছে। নতুন কাঠামোতে মজুরি পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়ও আছে। অনেক শ্রমিকনেতা এখনো জেলে। এ জন্য বিদেশ থেকে উদ্বেগ জানানো হচ্ছে। নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার যদি শ্রম ইস্যুতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তাতে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।