লাভ কমে যাওয়ায় কমছে আমবাগান, বাড়ছে অন্য ফলের আবাদ

রাজশাহীতে মোট ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এসব আমবাগান কেটে এখন অন্যান্য ফসল চাষ করা হচ্ছে।

কৃষকেরা একের পর এক আমবাগান কেটে ফেলছেন। সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ভায়ালক্ষ্মীপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

‘রাজা নেই শাহি নেই রাজশাহী নাম, হাতি–ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম’—ষাটের দশকের সিনেমার গানটিই বলে দেয় রাজশাহী আমের দেশ। কিন্তু এখন অন্যান্য কৃষিপণ্যের দামের সঙ্গে আম আর যেন পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছে না। তাই ঐতিহ্যের কথা ভুলে বাগানমালিকেরা একের পর এক আমবাগান কেটে সেসব জায়গায় অন্য ফসলের আবাদ শুরু করছেন। কেউ কেউ অবশ্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিবেচনা করে নতুন জাতের আমগাছ লাগাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমগাছ কেটে অন্য ফসল চাষ করা হচ্ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে মোট ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমির আমবাগানই রয়েছে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায়, যেখানকার আমের সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে।

বাপ-দাদার হাতে লাগানো গাছ বলে মায়ায় এত দিন কাটতে পারিনি। কিন্তু ফজলি আম ধরে কম। আবার ঝরে যায়। শেষ পর্যন্ত পরিচর্যার খরচই ওঠে না। বাধ্য হয়ে তাই ফজলি আমের বাগান কেটে ফেললাম।
আজিম উদ্দিন, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুংলী গ্রামের আমচাষি

চাষিরা বলছেন, আগের মতো গাছ লাগিয়ে রাখলেই আর আম হচ্ছে না। ব্যাপক পরিচর্যা করতে হয়। পরিচর্যার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সেই অনুপাতে আমের দাম বাড়ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম আরও কমছে। তার বিপরীতে অন্য ফসলের দাম বাড়ছে। তাই আম ছাড়া এখন অন্য ফসলে লাভ বেশি। এ জন্য অনেকে পুরোনো বাগান কেটে নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে সম্ভাবনাময় গাছ লাগাচ্ছেন। চারঘাট ও বাঘার কোথাও না কোথাও প্রতিদিন আমগাছ কাটার ঘটনা ঘটছে।

চারঘাটের মুংলী গ্রামের আমচাষি আজিম উদ্দিন সম্প্রতি তাঁর ফজলি আমের প্রায় ৯০ বছর বয়সী বাগান কেটে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার হাতে লাগানো গাছ বলে মায়ায় এত দিন কাটতে পারিনি। কিন্তু ফজলি আম ধরে কম। আবার ঝরে যায়। শেষ পর্যন্ত পরিচর্যার খরচই ওঠে না। বাধ্য হয়ে তাই কেটে ফেললাম।’ আজিম উদ্দিনের বাগানের পাশে আরেক চাষি ১৮ কাঠা জমির আমবাগান কেটে এবার গম চাষ করেছেন। ওই গম থেকে এবার ৫০ হাজার টাকা আয় হবে। আজিম উদ্দিন বলেন, আমবাগানের জমিতে এবার তিনি সবজি চাষ করবেন। জমির পরিমাণ প্রায় এক বিঘা। সবজি চাষ করলে ২০ হাজার টাকা আয় হবে। তাই আমগাছ পুষে কোনো লাভ নেই।

চারঘাটের ভায়ালক্ষ্মীপুর গ্রামের আমচাষি পলাশের বাগানে ১৮টি লকনা আমগাছ কাটা হয় গত ৫ ডিসেম্বর। গাছ কাটার কারণ জানতে চাইলে শ্রমিক আবদুল ওহাব বলেন, ‘আমগাছে ভাত হচ্ছে না। আমের যা দাম, তা বিক্রি করে কীটনাশকের দামই উঠছে না।’ ওই জমির পাশে একই গ্রামের মাসুদ রানার ১০ কাঠা জমিতে আমবাগান ছিল। সেখানে একটি গাছ রেখে এখন শর্ষের আবাদ করেছেন। মাসুদ রানা বলেন, এবার বাগানে তিন হাজার টাকার বেশি আম বিক্রি করতে পারেননি। গাছ কাটার পর সবজি চাষ করে তিন মাসে সাত হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। এরপর শর্ষে চাষ করেছেন।

চারঘাটের বনকিশোর গ্রামের কলেজশিক্ষক ইসহাক আলী ও তাঁর চাচারা মিলে আশ্বিনা ও ফজলি জাতের ৪০টি আমগাছ কেটেছেন। ইসহাকের ভাষ্য, গাছগুলোর বয়স প্রায় ৬০ বছর হয়ে গেছে। এক বছর আম হয়, পরের বছর হয় না। আমের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে গাছগুলো কাটা হয়েছে।

চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন্নাহার বলেন, এ উপজেলায় আমবাগান আছে ৪ হাজার ৮০০ হেক্টর। এর মধ্যে ৯৬ হেক্টর কমেছে। চাষিরা গাছ কেটে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় আমগাছ লাগাচ্ছেন।

বাঘা উপজেলার দিঘা গ্রামের কলেজশিক্ষক গোলাম তোফাজ্জল কবির তাঁর লকনা জাতের সাড়ে ৩০০ আমগাছ কেটে ফেলেছেন। তিনি সেই জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে শর্ষে চাষ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর বাগানের বয়স আট বছর হয়েছিল। কিন্তু আমের বাজার মন্দা, তাই গাছ কেটে ফেলেছেন। একইভাবে দিঘা নওদাপাড়ার জমির উদ্দিনও তাঁর দেড় বিঘা জমির গাছ কেটে আখ চাষ করেছেন। নওটিকা গ্রামের মনসুর রহমান এবার তাঁর আড়াই বিঘা আমবাগান কেটে ফেলেছেন। তিনি বলেন, আমবাগান থেকে বছরে ১৫ হাজার টাকার বেশি আয় হয় না। বাধ্য হয়ে তাই আমগাছ কেটে এবার সেই জমি ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দিয়েছেন।

বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বাঘায় মোট আমবাগান আছে ৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর। এর মধ্যে ১০৯ হেক্টর বাগান কেটে ফেলা হয়েছে। তবে অনেকেই পুরোনো জাতের গাছ কেটে নতুন জাতের আমগাছ লাগাচ্ছেন।