সাত বছরে প্রপার্টি লিফটসের বিক্রি বেড়ে ছয় গুণ, বিনিয়োগ ২০০ কোটি টাকা
দেশে ২০১৮ সাল থেকে নিজস্ব কারখানায় লিফট সংযোজন ও তৈরি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ‘প্রপার্টি লিফটস’ ব্র্যান্ড নামে এসব লিফট বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশে বহুতল ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব লিফটের চাহিদাও বাড়ছে। তাতে গত সাত বছরে প্রপার্টি লিফটসের লিফটের বিক্রি প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে।
লিফট তৈরি ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর দেশে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার লিফট বেচাকেনা হয়। টাকার অঙ্কে এই বাজার প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। গত কয়েক বছরে লিফটের বাজারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে দেশে লিফটের বাজারের বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর। দেশীয় দুই প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এখন স্থানীয়ভাবে লিফট তৈরি ও বাজারজাত করছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই বর্তমানে চাহিদার ২০-২৫ শতাংশ লিফট দেশে তৈরি হচ্ছে। মাত্র সাত বছরের মধ্যে এ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। ফলে কমছে আমদানিনির্ভরতা।
প্রাণ-আরএফএলের লিফট কারখানা নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এ কারখানাটির আয়তন প্রায় এক লাখ বর্গফুট। গতকাল শনিবার ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক প্রাণ-আরএফএলের কারখানা পরিদর্শনে যান। এ সময় লিফট তৈরির বিভিন্ন ধাপ, প্রযুক্তি ও বিপণন নিয়ে নানা তথ্য জানান আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল ও প্রপার্টি লিফটসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মঈনুল ইসলাম।
২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ
তিন দশকের বেশি সময় ধরে লিফট আমদানি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ১৯৮৮ সালে লিফট আমদানির মাধ্যমে এই ব্যবসায় যুক্ত হয় গ্রুপটি। পরে ২০১৮ সালে নরসিংদীর ডাঙ্গায় নিজেরাই লিফট তৈরি শুরু করে। বর্তমানে প্রপার্টি লিফটসের কারখানায় সাত ধরনের লিফট তৈরি হয়। এগুলো হচ্ছে প্যাসেঞ্জার, কার্গো, হাসপাতাল, হোম, ক্যাপসুল, হাইড্রোলিক ও সিজার লিফট।
আরএফএলের কর্মকর্তারা জানান, লিফট তৈরিতে মোটর, দড়ি, কন্ট্রোলারসহ মৌলিক কিছু কাঁচামাল তাঁরা আমদানি করেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ যন্ত্রাংশসহ লিফট তৈরির ৮০ শতাংশ কাজ এখানকার কারখানায় করা হয়। এ ছাড়া প্রপার্টি লিফটস ফিনল্যান্ডের কোনে, স্পেনের ম্যাকপুয়ার্সা এবং জার্মান ও চীনের এসআরএইচ ব্র্যান্ডের লিফটের বাংলাদেশি পরিবেশক হিসেবে কাজ করছে।
প্রাণ-আরএফএলের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে স্থানীয়ভাবে লিফট তৈরিতে ৪০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন করছে প্রপার্টি লিফটস। পাশাপাশি গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে বিশ্বমানের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসহ উন্নত প্রযুক্তির লিফট তৈরি করছে তারা। গত সাত বছরে এ খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটি। লিফটের কারখানায় কাজ করছেন ২১০ জন কর্মী। এ ছাড়া লিফট স্থাপন ও সার্ভিসিংয়ের জন্য সারা দেশে আরও এক হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
প্রপার্টি লিফটসের সিওও মঈনুল ইসলাম বলেন, লিফটের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রপার্টি লিফটস নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে। এ জন্য আমাদের লিফটে বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক—দুই ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। যেমন লিফটের দড়ি ছিঁড়ে গেলে তৎক্ষণাৎ সেটি নিয়ন্ত্রণে লিফটে অটো রেসকিউ যন্ত্র (এআরডি) যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্যও আমাদের লিফটে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মোটর ব্যবহার করা হয়।
রপ্তানি শুরুর পরিকল্পনা
প্রাণ-আরএফএলের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বহুতল ভবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে তাঁদের তৈরি লিফটের চাহিদাও বাড়ছে। ২০১৮ সালে শুরুর বছর ৫৫টি লিফট বিক্রি করেছিল প্রপার্টি লিফটস। গত বছর এই সংখ্যা বেড়ে ৩২৯টিতে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, কোরীয় ইপিজেড, বে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বহুজাতিক কোম্পানি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রপার্টি লিফট ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রপার্টি লিফটসের লিফট সাধারণত ৩০০ কেজি থেকে ১০ হাজার কেজি ধারণক্ষমতার। তবে গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে লিফটের নকশা ও বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে দেওয়া হয়। আরএফএলের কারখানায় প্রতি মাসে ২৭০টি লিফট তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে মাসে গড়ে ১০০টি লিফট তৈরি হচ্ছে। ধারণক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এসব লিফটের দাম ১৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা পর্যন্ত। দেশে লিফট আমদানিতে প্রায় ৪৬ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। ফলে সমমানের আমদানি করা লিফটের তুলনায় ৫-৭ লাখ টাকা কম দামে দেশে তৈরি লিফট বিক্রি হচ্ছে।
দেশীয় বাজার ছাড়া রপ্তানির দিকেও নজর দিচ্ছে প্রপার্টি লিফটস। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, আগামী বছর থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে লিফট রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল বলেন, দেশে মূল্য সংযোজন বাড়িয়ে লিফট তৈরি করতে পারলে দাম কমে আসবে। এতে লিফটের ব্যবহারও অনেকাংশে বাড়বে। তবে দেশে তৈরি লিফটের ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দেশে তৈরি লিফট ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হলে লিফটের বাজারে স্থানীয় কোম্পানির হিস্যা বাড়বে।