বিশ্বের সেরা কারখানা এখন বাংলাদেশে

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সর্বশেষ তালিকায় বিশ্বের পরিবেশবান্ধব শীর্ষ ১০০ কারখানার মধ্যে ৫২টি বাংলাদেশের। 

বিশ্বসেরা পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে ইউএসজিবিসির সনদ পেয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল। হংকংভিত্তিক এপিক গ্রুপ ও বাংলাদেশের এনভয় লিগ্যাসির যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি ১১০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ১০৪
ছবি: গ্রিন টেক্সটাইলের সৌজন্যে

বিশ্বের এক নম্বর বা শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানা এখন বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) মান সনদে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় সারা বিশ্বে শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের চতুর্থ ইউনিট।

এটি পরিবেশবান্ধব কারখানার বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০৪ পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ইউএসজিবিসি এ সনদ ইস্যু করেছে। তবে গতকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

ইউএসজিবিসির সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৮টিই বাংলাদেশের। বাকি দুটির একটি ইন্দোনেশিয়ার ও একটি শ্রীলঙ্কার। ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সেরা পরিবেশবান্ধব কারখানাটি ছিল ইন্দোনেশিয়ায়। কারখানাটি ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০১ পেয়েছিল। এখন শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে গ্রিন টেক্সটাইল।

এ ছাড়া শীর্ষ ১০-এর তালিকায় থাকা বাংলাদেশি বাকি ৭টি কারখানার মধ্যে রয়েছে–রেমি হোল্ডিংস, ফতুল্লা অ্যাপারেলস, তারাসিমা অ্যাপারেলস, প্লামি ফ্যাশনস, সিল্কেন সুইং, মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ। এ তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশি কারখানাটির নাম প্রকাশ করা হয়নি। শুধু দেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

‘এ অর্জন বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুনামও বিশ্বে অনেক বাড়িয়ে দেবে। আশা করছি বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পণ্যমূল্যের দর-কষাকষির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যেকোনো ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।’
তানভীর আহমেদ, গ্রিন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ইউএসজিবিসি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল। পৃথিবীজুড়ে এটি পরিবেশবান্ধব ভবন ও কারখানা নির্মাণে পরামর্শ ও সহায়তা করে থাকে। এমনকি পরিবেশবান্ধব কারখানা বা স্থাপনার তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ডও রয়েছে তাদের। সংস্থাটির দেওয়া সনদ এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ সংস্থার সনদকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে। এ জন্য ইউএসজিবিসির সনদকে এ দেশের শিল্প উদ্যোক্তারাও বেশ গুরুত্ব দেয়।

ইউএসজিবিসির তালিকায় শীর্ষ দশে থাকা সব কারখানা লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ৮০ বা এর বেশি নম্বর পায়, এমন কারখানাকে এ সনদ দেওয়া হয়। লিড-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন মানদণ্ডে নির্ধারিত মান রক্ষা করতে হয়। নির্ধারিত মান বজায় রেখে নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও এ সনদের জন্য আবেদন করতে পারে কারখানাগুলো।

গ্রিন টেক্সটাইল দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র খাতের একটি কারখানা। এটির মালিকানায় রয়েছে পোশাক খাতের হংকংভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি এপিক গ্রুপ ও বাংলাদেশের এনভয় লিগ্যাসি। এনভয় লিগ্যাসির পক্ষে গ্রিন টেক্সটাইল পরিচালনায় রয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুব উদ্দিন আহমেদ। তাঁর ছেলে তানভীর আহমেদ বর্তমানে গ্রিন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

জানতে চাইলে তানভীর আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অর্জন বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুনামও বিশ্বে অনেক বাড়িয়ে দেবে। আশা করছি বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পণ্যমূল্যের দর-কষাকষির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যেকোনো ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।’

‘এ অর্জন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রতিযোগী দেশগুলোর কেউই বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই। আশা করছি, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পোশাকের দাম বাড়াতে সহায়তা করবে।’
মোহাম্মদ হাতেম, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি

কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ৫৪ হাজার বর্গফুটের কারখানাটি তৈরিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক উৎসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কারখানায় ৬৫ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। এ ছাড়া কারখানাটিতে জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বেশি করা হয়। কারখানার বিদ্যুতের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করা হয় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে।

গ্রিন টেক্সটাইল সূত্রে জানা যায়, ভালুকায় কোম্পানিটির নিজস্ব শিল্প এলাকায় এরই মধ্যে চারটি ইউনিট রয়েছে। এ চারটি ইউনিটের মধ্যে চতুর্থটি পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকি তিনটি ইউনিটের মধ্যে তৃতীয়টিও ‘লিড প্লাটিনাম’ কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকি দুটি ইউনিট ‘গোল্ড’ সনদপ্রাপ্ত। কোনো কারখানা ইউএসজিবিসির বিভিন্ন মানদণ্ডে ৬০ থেকে ৭৯ নম্বর পেলে সেটি ‘গোল্ড’ সনদ পায়। আর ৫০ থেকে ৫৯ নম্বর পেলে ‘সিলভার’ এবং ৪০ থেকে ৪৯ নম্বরে ‘সার্টিফায়েড’ সনদ পায়।

শীর্ষ ১০০ কারখানা ৫২টিই বাংলাদেশের

ইউএসজিবিসির তালিকায়, বিশ্বের পরিবেশবান্ধব শীর্ষ ১০০ কারখানার মধ্যে ৫২টিই বাংলাদেশের। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের রয়েছে ১০টি কারখানা। এরপর পাকিস্তানের আছে ৯টি কারখানা। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের আছে ৬টি করে ১২টি কারখানা। ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের আছে ৪টি করে ৮টি কারখানা। বাকিগুলো অন্যান্য দেশের।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের হিসাবে, বর্তমানে লিড প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভারসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ১৮৩। এর বাইরে আরও পাঁচ শতাধিক কারখানা পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বেশ কিছু শ্রেণিতে নম্বর বণ্টনের মাধ্যমে লিড প্লাটিনাম সনদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেকসই কারখানা প্রাঙ্গণ, দক্ষতার সঙ্গে পানির ব্যবহার, টেকসই জ্বালানি ও পরিবেশ, উপকরণ ও সম্পদ, উদ্ভাবন ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার ইত্যাদি।

পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমানের হাত ধরে ২০১২ সালে দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয়। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাশাপাশি জাহাজনির্মাণ, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য খাতেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। এ ছাড়া এখন পরিবেশবান্ধব বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে, তবে তা সংখ্যায় কম।

পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও শীর্ষে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অর্জন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রতিযোগী দেশগুলোর কেউই বাংলাদেশের ধারেকাছে নেই। আশা করছি, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পোশাকের দাম বাড়াতে সহায়তা করবে।’