ব্যবসার খরচ বাড়ছে, চাপে উদ্যোক্তারা 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পণ্যের দাম নির্ধারণে জবাবদিহি থাকলে এবং প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ হলে ব্যবসার খরচ কিছুটা হলেও কমবে। 

গত দুই বছরে শুধু ডলারের বিনিময় মূল্যই বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। গ্যাসের দাম ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিদ্যুতের দামও বেড়েছে কয়েক দফা। নতুন করে গত মাসে এক দফায় সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। ডিজেলের দাম ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধির পর চলতি মাসে কমানো হয়েছে ৭৫ পয়সা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপও আছে। সুদের হার আবার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। দুই বছর ধরে এভাবেই দেশে ব্যবসার খরচ হু হু করে বেড়ে চলেছে।

বিভিন্ন খাতের কয়েকজন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী বলছেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর নতুন করে টিকে থাকার লড়াইয়ে আছেন তাঁরা (ব্যবসায়ীরা)। গ্যাসের দাম কয়েক গুণ বাড়ানোর পরও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস মিলছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে সমন্বয় করা হয়েছে যৎসামান্য। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলেও শুল্ক-করে কোনো ছাড়ের উদ্যোগ নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্যবসার খরচ কমে, এমন কোনো উদ্যোগও সরকারের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁদের। 

দেশের ব্যবসার খরচ যে বাড়ছে, তা বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে। বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) গত বছর ব্যবসার আস্থা সূচক নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, সামগ্রিকভাবে ব্যবসাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের আস্থা বাড়লেও উৎপাদনে ব্যবহার করা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিসভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোয় উদ্যোক্তাদের কপালের ভাঁজ আরও চওড়া হতে পারে। 

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবায় খরচ বেড়েছে ৪০০ শতাংশ এবং ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পণ্য পরিবহনে খরচ কিলোমিটারপ্রতি বিশ্বের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যবসার এই খরচ কমাতে না পারলে সামনের দিনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রণোদনা বা ভর্তুকির দরকার নেই, ব্যবসার খরচ কমাতে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। 

ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়। এর পর থেকে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রল ১২৫ টাকা ও অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। এতে পরিবহন ব্যয়ের সঙ্গে পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। 

বিশ্ববাজারে ২০২২ সালের মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ ডলারে পৌঁছায়। একই সময়ে ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর দাম কমতে থাকে। বিশ্ববাজারে ডিজেলের গড় দাম ১৩৯ ডলার ধরে দেশে নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার। গত বছর জ্বালানি তেলের দাম কমে ৭০ ডলারে নেমে আসে। বর্তমানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮২ দশমিক ৫৯ ডলার। তারপরও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়নি। 

গ্যাসের দাম গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) পাশাপাশি বড়, মাঝারি, ছোট ও বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা করা হয়। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয় এক লাফে বেশ বেড়ে যায়। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়। বছর ঘুরতেই আবারও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। গত মাসে গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি দাম ৭০ পয়সা বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। 

প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের দামও ভোগাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ২০২২ সালের এ সময়ে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দাম ১১০ টাকা। তবে আমদানিকারকদের ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৩-১২৫ টাকায়। এতে কাঁচামাল কিংবা পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। এতে ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে।

জানতে চাইলে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণের সুদহারও পৌনে ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পৌনে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতি ডলারে আমরা ৭-৮ টাকা কম পাচ্ছি বা ঠকছি। নতুন করে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। অথচ বিদ্যুৎ খাতে একধরনের লুটপাট চলছে।’ 

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশি সুতার মূল প্রতিযোগী ভারত। আগে থেকেই তাদের তুলনায় আমাদের উৎপাদন ব্যয় কয়েক সেন্ট বেশি ছিল। এখন ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভারতের সঙ্গে আমাদের সুতার উৎপাদন ব্যয় কেজিতে আরও ৩০ সেন্ট বেড়েছে। এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে বস্ত্রকলগুলোয় ভবিষ্যতে আলো জ্বলবে না। সংযোগশিল্প বন্ধ হলে তৈরি পোশাক খাতও একসময় বিপদে পড়বে।’ 

ব্যবসায়ীরা যা বলছেন

কাগজের কাপ বানিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী কাজী সাজেদুর রহমান। এসএমই ফাউন্ডেশনের সেরা উদ্যোক্তা পুরস্কার পাওয়া এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘দুই বছর আগে ১ টাকার কাগজের কাপের উৎপাদন ব্যয় ছিল ৬৫-৭০ পয়সা। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের বোঝা। মূল্যস্ফীতির কারণে কর্মীদের মজুরি অন্য সময়ের চেয়ে বেশি বাড়াতে হয়েছে। তাতে ১ টাকার কাগজের কাপের উৎপাদন ব্যয় ৯০-৯৫ পয়সায় পৌঁছেছে। খরচ বাড়লেও পণ্যের দাম বাড়াতে পারিনি। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কাগজের কাপের চাহিদা কমে গেছে।’

কাজী সাজেদুর রহমান আরও বলেন, ব্যবসার খরচ কমাতে নিকেতনে নিজের অফিস ছেড়ে দিয়েছেন। রূপগঞ্জের কারখানাতেই এখন তিনি অফিস করেন। তিনি আরও বলেন, দেশে দু-এক বছর আগেও কাগজের কাপ তৈরির ২৫টি কোম্পানি ছিল। বর্তমানে তিন-চারটির বেশি উৎপাদনে নেই। বাকিরা যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিতে চাইছে।

রাজধানীর কোনাপাড়ায় অবস্থিত শাহরিয়ার স্টিল মিলসের রড বিক্রি প্রতিবছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ত। এখন উল্টো ২০ শতাংশ করে কমছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যবসার বাড়তি খরচ। শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানিতে প্রতি ডলারে ১২৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এলএনজি আনার কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো; কিন্তু গ্যাস পাচ্ছি না। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন কর বাড়ানো হয়েছে। উৎপাদন খরচ যেটুকু বেড়েছে, তা পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করা যায়নি।’ তিনি বলেন, সরকার চাইলে এই কঠিন সময়ে কিছুটা ছাড় দিতে পারে। গ্যাস দিতে না পারলে দাম কমানো হোক। শুল্ক–কর কিছুটা কম নিতে পারে। বিদ্যুতে কিছু ভর্তুকি দিতে পারে। 

গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখানে এক্সক্লুসিভ ক্যান নামের কারখানায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বাক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠানটি ডলারের উচ্চ মূল্যের পাশাপাশি সংকটের কারণে ভুগছে। 

এক্সক্লুসিভ ক্যানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাছির প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম দুই বছরে ৪৫-৪৬ শতাংশ বেড়েছে। তারপরও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম কমলেও বেশি কর আদায়ের জন্য শুল্কায়নের সময় অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বেশি ধরছেন কর কর্মকর্তারা। আবার গত মাসে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ থেকে ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা সহজ করার সব কটি সূচকের অবনমন ঘটেছে।’ 

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অপ্রচলিত ব্যয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। যেমন নতুন লাইসেন্স কিংবা নবায়ন, সরকারি চুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়মিতই ঘুষ দিতে হয়। তার সঙ্গে আছে কম উৎপাদনশীলতা। এ জন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এমনিতেই ব্যবসার খরচ বেশি। মুনাফা কমিয়ে কিংবা প্রণোদনা নিয়ে টিকে থাকেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এই চাপ থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারেন না।