দেশে ব্যবসার পরিবেশের তিন সূচকের অবনতি

বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে। এই জরিপের তথ্যানুযায়ী, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার কারখানা বা ব্যবসার জন্য জমি পাওয়াটাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে।

দ্বিতীয়বারের মতো বিবিএক্স জরিপ পরিচালনা করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর পরিশোধ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ঋণের প্রাপ্যতা—এই ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করা হয়েছে।

জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার পরিবেশের সূচকের ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৬১ দশমিক শূন্য ১। গত বছর সেই স্কোর সামান্য বেড়ে ৬১ দশমিক ৯৫ হয়। সূচকের মানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ার বড় কারণ ১০টি সূচকের মধ্যে ৪টির অবস্থা খারাপ। বাকি ৬টি সূচক উন্নতির দিকে। ১০ সূচকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে অবকাঠামো। আর সবচেয়ে খারাপ ঋণের প্রাপ্যতা।

গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে আটটি বিভাগের সেবা, উৎপাদন ও কৃষি খাতের ৫১৮ জন ব্যবসায়ীর ওপর বিবিএক্স জরিপটি পরিচালনা করা হয়। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ কুটির ও ক্ষুদ্র, ১০ শতাংশ মাঝারি ও ১৫ শতাংশ বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তা। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে এমসিসিআই কার্যালয়ে জরিপের এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

ব্যবসার পরিবেশ সূচকের জরিপের ফলাফলের প্রকাশনা হাতে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ অন্যরা। মেট্টো চেম্বার ও পলিসি এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে এই জরিপ করেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে মেট্টো চেম্বার কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

টানা দেড় দশক ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের ১৯০টি দেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি তৈরিতে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। ২০২০ সালে সংস্থাটির ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৪৫।

বিবিএক্স জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে এমসিসিআই সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক সহজে ব্যবসা সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করার পর সেই শূন্যস্থান পূরণে কাছাকাছি একটি সূচক আমরা তৈরি করেছি। এর মাধ্যমে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি করতে কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, তা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।’

জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ব্যবসার পরিবেশের তিন সূচক—জমির প্রাপ্যতা, কর পরিশোধ ও ঋণপ্রাপ্যতায় গত বছর বেশ অবনতি হয়েছে। সংস্কার কর্মসূচি ছাড়া এই জায়গায় উন্নতির সুযোগ কম।

কোনো সূচকের স্কোর যদি ০ থেকে ৪০-এর মধ্যে থাকে, তার মানে হলো দেশে ব্যবসার পরিবেশ খুবই কঠিন। ঋণপ্রাপ্যতা সূচকে স্কোর ৩৫ দশমিক ২২। ২০২১ সালে এটি ছিল ৫০ দশমিক ৭৮। জরিপে ৮৭ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংকঋণ ও অর্থায়ন পেতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের কথা জানান।

কোনো সূচকের স্কোর ৪১ থেকে ৬০-এর মধ্যে থাকা মানে সেখানে ব্যবসায় বেশ কিছু বাধা রয়েছে। এ স্কোরের মধ্যে আছে তিনটি সূচক। তার মধ্যে ৫৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ নিয়ে তলানিতে আছে জমির প্রাপ্যতা সূচক। ২০২১ সালে এই সূচকে স্কোর ছিল ৫৮ দশমিক ৯০। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬ শতাংশ ব্যবসায়ী জানান, জমি ক্রয়–বিক্রয়ে তাঁরা সরকারি সংস্থার হয়রানির মুখে পড়েছেন। এ ছাড়া বাণিজ্য সুবিধা সূচকে স্কোর ৫৮ দশমিক ৬১ এবং কর পরিশোধ সূচকে স্কোর ৫৫ দশমিক ২১। কর পরিশোধ সূচকে ২০২১ সালে স্কোর ছিল ৬৮ দশমিক ৭২। জরিপে অংশ নেওয়া ৬০ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী আয়কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান। এমনকি ৭৬ শতাংশ মন্তব্য করেছে, বর্তমান করব্যবস্থার কারণে তাঁদের ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

আবার কোনো সূচকের স্কোর ৬১ থেকে ৮০-এর মধ্যে থাকা মানে দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির দিকে। এ স্কোরের মধ্যে আছে ছয়টি সূচক। তার মধ্যে ৬০ দশমিক ৬০ স্কোর নিয়ে তলানিতে আছে প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী বলেছেন, তাঁরা নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যারে বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া বিরোধ নিষ্পত্তি সূচকে স্কোর ৬৪ দশমিক ২৪, ব্যবসা শুরুর সূচকে ৭০ দশমিক ৭৮, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি সূচকে ৭২ দশমিক ৮৫, শ্রমনীতি সূচকে ৭৪ দশমিক ৪০ স্কোর এবং অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭৪ দশমিক ৮৫। অন্যদিকে ৮১ থেকে ১০০ স্কোর থাকলে বলা হয়, পরিবেশ ব্যবসাবান্ধব। এ স্কোরে কোনো সূচক আপাতত নেই।

জরিপে দেখা গেছে, ১০টি সূচকে খাতভেদে ব্যবসায়ীদের সমস্যাও ভিন্ন ভিন্ন। ব্যবসা শুরু করা ওষুধ ও রাসায়নিক খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য তুলনামূলক সহজ হলেও পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা অনেক কঠিন। আবার ব্যবসার পরিবেশের স্কোরে ময়মনসিংহ বিভাগ এগিয়ে। রংপুর সবচেয়ে পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে ময়মনসিংহে স্কোর ৬৫ দশমিক ২৩ আর রংপুরের স্কোর ৫৫ দশমিক ৭৬।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পদে পদে যদি সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা যতই প্রচার-প্রচারণা চালাই না কেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবে না। আমরা মুখে যা বলছি, বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন। সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপি (কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার) আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিন বছর ধরে কথা হচ্ছে। কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আমরা কথায় অনেক স্মার্ট, তবে কাজে তেমনটা নই।’

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, বিডার ওয়ান–স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) বা এক দরজায় সেবা নিয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে তা তিন-চার মাসের সমাধান হয়ে যাবে।

জরিপের প্রতিবেদন নিয়ে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমে প্রশ্ন করেন ব্যবসায় বিরোধ হলে নিষ্পত্তি কীভাবে করা হয়। ফলে দ্রুত সময়ের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কার্যকর উদ্যোগ দরকার।

জরিপের তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয়, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন প্রমুখ।