খেলাপি ঋণের ৪০ শতাংশই বাণিজ্যিক ও পোশাক খাতে

  • ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।

  • গত বছর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা।

  • খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে জাহাজভাঙা ও নির্মাণশিল্প। এই খাতে ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার সবই ছিল ট্রেডিং বা বাণিজ্যিক ঋণ। এসব ঋণের বেশির ভাগই পণ্য আমদানির বিপরীতে দেওয়া হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বড় উদ্বেগ এখন বাণিজ্যিক ঋণে। ব্যাংকগুলো এককভাবে সবচেয়ে বেশি ঋণও দিয়েছে এই খাতে। মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশই এই খাতের ঋণ।

বাণিজ্যিক ঋণের পরেই খেলাপির শীর্ষে আছে তৈরি পোশাক খাতের ঋণ। দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এ দুই খাতের। অর্থাৎ দেশের খেলাপি ঋণের এক-তৃতীয়াংশই এ দুই খাতে পুঞ্জীভূত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন, ২০২২ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে খুব বেশি নথিপত্র প্রয়োজন হয় না। কিছু ব্যাংক সহজেই এই ঋণ দিয়ে থাকে। এর আগে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এই খাতের ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক আটকা পড়েছিল। এরপর এখন আবারও কিছু ব্যাংক এই খাতের ঋণে ঝুঁকছে, যা পুরো ব্যাংক খাতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে অর্থ পাচারও সহজ। কারণ, পণ্যের পরিমাণ অনেক হওয়ায় তা সব সময় যাচাই করা হয় না। এ জন্য ব্যাংকগুলোর এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে বাছবিচার করে দেওয়া উচিত।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক ঋণে অনেক ব্যাংকের টাকা আটকে গেছে। বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে অর্থ পাচারও সহজ। কারণ, পণ্যের পরিমাণ অনেক হওয়ায় তা সব সময় যাচাই করা হয় না। এ জন্য ব্যাংকগুলোর এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে বাছবিচার করে দেওয়া উচিত। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় একধরনের প্রতিযোগিতাও থাকে, যা ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।

 সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, অন্য ঋণের চেয়ে শিল্প খাতের ঋণ তুলনামূলক ভালো। এসব ঋণ নিয়ে কী হচ্ছে, তা দেখা যায়। ফলে তদারকি সহজ হয়।

আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ গেছে ট্রেড ও কমার্স বা বাণিজ্যিক খাতে। এই খাতে ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৮ হাজার ৯০২ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশ। ২০২১ সালে এই খাতে ঋণ ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা।

গত বছর শেষে দেশের খেলাপি ঋণের ২৪ শতাংশই ছিল বাণিজ্যিক ঋণ। আর ১৬ শতাংশ ছিল পোশাক খাতের।

ঋণের দিক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে বড় শিল্প খাত। এ খাতে ২০২২ সাল শেষে ঋণ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এরপরই পোশাক খাতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। পোশাক খাতে ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকায়।

নির্মাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ এবং অন্য সেবা খাতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। টেক্সটাইল খাতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৭ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে, এমন খাতগুলোর মধ্যে আরও আছে কৃষিভিত্তিক শিল্প। এসব খাতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৯ হাজার ৪১ কোটি টাকা।

এদিকে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে জাহাজভাঙা ও নির্মাণশিল্প। এই খাতে ২০২২ সাল শেষে ঋণ ছিল ২১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা বা ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরপরই খাতভিত্তিক খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে টেক্সটাইল ও পোশাক খাত।

গত বছর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এর বাইরে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি গত বছর শেষে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। পাশাপাশি অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯ হাজার ৭২১ কোটি টাকায়।

ফলে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে রয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ছিল ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তবে ওই সময়ে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোর এই অনুপাত ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ভারতের ১৬ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ।